হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা: Islamic World

আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর উম্মত তার সমগ্র ইতিহাসে বিগত শতাব্দী পর্যন্ত দু'টো বিভ্রান্তি থেকে সুরক্ষিত ছিলো। প্রথমত, এই উম্মতের ইতিহাসে এমন কোনো নজীর খুঁজে পাওয়া যায়না যে, কোনো নবুওয়তের দাবিদার নিশ্চিন্তে ও নিরুপদ্রবে নিজের মিথ্যে  নবুওয়তের প্রচারের সুযোগ পেয়েছে এবং এর সুবাদে একটা আলাদা দল বা গোষ্ঠি গড়ে উঠতে পেরেছে। আর সেই দল অবাধে নিজের মতাবাদের প্রচার ও চিন্তাধারার বিস্তার ঘটিয়ে এবং স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে এই উম্মতেরই ক্রোড়ে বিকাশ লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম উম্মাহ কখনো নিজের সমাজ কাঠামোর অভ্যন্তরে এমন কোনো গোষ্ঠিকে গড়া উঠা ও বিকাশ লাভ করার সুযোগ দেয়নি, যে কুরআন ব্যতীত ইসলামি আইনও বিধানের দ্বিতীয় কোনো উৎসর অস্তিত্ব স্বীকার করেনা এবং মুসলমানদের উপর সেই উৎসের আনুগত্য করার বাধ্যবাধকতা আছে বলে মনে করেনা। এ কথা সত্য, মুসলিম উম্মাহর ভেতরে এযাবত বেশ কয়েকজন মিথ্যা নবী আবির্ভূত হয়েছে। তবে তাদের প্রত্যেকের এতোদসংক্রান্ত প্রচারণাকে প্রথম সুযোগেই এমনভাবে নির্মুল করে দেয়া হয়েছে যে, ইতিহাসের পাতায় সেটা নিছক একটা শিক্ষামূলক ঘটনা হয়ে রয়েছে। অনুরূপভাবে দু'একটা গোষ্ঠি রসূল সা.-এর কথা ও কাজকে শরিয়তের উৎস হিসেবে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেছে, বিশেষ করে তাদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও আকীদা শাস্ত্রীয় মতবাদকে খণ্ডন করে এমন হাদিসগুলোকেই তারা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। কিন্তু উম্মাহর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অনতিবিলম্বে তাদেরকে রয়কট করেছে এবং  তারপর মুসলিম জাতি শত শত বছরব্যাপী এ ধরণের লোকদের প্রাদুর্ভাব থেকে মুক্ত থেকেছে। আসলে আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদীর হৃদয়ে স্বীয়  নবীর প্রতি এমন নজীরবিহীন ভালোবাসা ও মমত্ববোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, তার সামষ্টিক বিবেক সব সময় এ ধরণের লোকদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার ও চুলচেরা তত্ত্বকথা দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করেছে এবং কখনো তাকে দীর্ঘস্থায়ী ও সার্বজনীন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে দেয়নি। গভীর নবীপ্রেমে উজ্জীবিত এই মুসলিম উম্মাহ স্বীয় নেতা ও পথপ্রদর্শক রসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতিটি পদক্ষেপকে আপন জীবন পথের অভিযাত্রায় একমাত্র দিকনির্দেশক হিসেবে বহাল রেখেছেন। কিন্তু  আমাদের দুর্ভাগ্যজনক উদাসীনতার কুফলস্বরূপ বিগত শতাব্দীতে মিথ্যা নবুওয়ত ও হাদিস অমান্য করা- এই উভয় গোমরাহী আমাদের সমাজে জন্ম নিয়েছে এবং আমাদের মধ্যে তার বিকাশ ও বিস্তার অব্যাহত রয়েছে। একদিক দিয়ে বিবেচনা কবলে মিথ্যা নবুওয়তের তুলনায় হাদিস অমান্য করার ভ্রষ্টতা অনেক বেশি বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। এর কারণ, প্রথমোক্ত গোষ্ঠির আহবান এক বিকৃত  ব্যক্তিত্ব ও তার অবাঞ্ছিত দাবিদাওয়ার প্রতি এবং তা স্বভাবতই কোনো মুসলমানের মধ্যে আকর্ষণ ও সম্মোহন সৃষ্টি করতে অক্ষম। এ গোষ্ঠির দাওয়াত ও প্রচারণা যে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর নামান্তর, তা অনেকটা স্পষ্ট। কিন্তু শেষোক্ত গোষ্ঠির দাওয়াত আপাত দৃষ্টিতে খুবই নির্দোষ ও চমকপ্রদ মনে হয়। বাহ্যত এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এরা শুধুমাত্র আল্লাহর কিতাবের দিকেই মানুষকে ডাকে এবং কুরআনকেই মানুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু বানাতে তৎপর। এজন্য একজন মুসলমানের পক্ষে সহজেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সে এটা টেরই পায়না যে, এই গোষ্ঠির আসল লক্ষ্য হলো কুরআন ও হাদিসের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি এবং অবশেষে কুরআনকে তার বাহকের মৌখিক ও বাস্তব ব্যাখ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের মনগড়া রকমারি ব্যাখ্যার খেলনা পুতুলে পরিণত করা।

হাদিস অস্বীকার করার কুটীল মতবাদের প্রবক্তারা যেহেতু ভালো করেই জানে, রসূল সা.-এর সুমহান ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের সাথে মুসলমানদের কি অটুট ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক এবং তাঁর প্রতি তাঁরা কতো প্রবলভাবে আকৃষ্ট ও নিবেদিত, তাই রসূল সা.-এর সুন্নত ও হাদিসের মর্যাদা তাদের মন থেকে নি:শেষ করা এবং তাঁর প্রতি সাধারণ মুসলমানদর মধ্যে বীতশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞার মনোভাব জন্মানোর জন্য তারা হাদিসের বিরুদ্ধে নানা রকমের সন্দেহ সংশয়, আপত্তি, অভিযোগ ও কুপ্ররোচনা ছাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। এর ভেতরে যেসব অভিযোগ কিছুটা গুরুত্বের দাবিদার, তার অধিকাংশেরই জবাব আলেম সমাজের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে। তথাপি অভিযোগকারীরা সেগুলোকে বিভিন্নভাবে নতুন করে তুলেছে। তাই বিভিন্নভাবে সেগুলোর জবাব দেয়া এবং সেইসব অভিযোগের যৌক্তিক বিভ্রান্তিগুলোর প্রতিটি দিক স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়া অব্যাহত রাখা প্রয়োজন, যাতে মুসলিম জনগণ এগুলোর অসারতা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং চিন্তাভাবনা না করেই এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার খপ্পড়ে না পড়ে। এই দিকটা বিবেচনা করেই এখানে এই মহলের কয়েকটি মৌলিক অভিযোগের উদ্ধৃতি ও তার সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছি।

আমি আপাতত, হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির প্রধান প্রধান তিনটি অভিযোগের জবাব দিচ্ছি। এ তিনটি অভিযোগকে তারা খুবই জোরেশোরে বারবার উল্লেখ করে থাকে। প্রথম অভিযোগ এই যে, ইসলামে যদি হাদিসের তেমন গুরুত্বপূর্ণ স্থান থাকতো এবং তা যদি ইসলামি বিধানের চিরন্তন ও উচ্চতর কোনো সনদ বা উৎস হতো, তাহলে রসূল সা. যতোটা গুরুত্ব সহকারে কুরআনের প্রতিটি আয়াতকে লিখিয়ে নিতেন, ঠিক ততোটা গুরুত্ব দিয়েই প্রতিটি হাদিসকে লিখিয়ে রেখে যেতেন। যে জিনিসকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে লিপিবদ্ধ করে অন্যদের নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়নি, সেটা একটা চিরন্তন ও অবশ্য পালনীয়  আইনের মর্যাদা কিভাবে পায়?

দ্বিতীয় অভিযোগটা হলো, হাদিস  যদি কুরআনের মতোই ইসলামি বিধানের উৎস হয়ে থাকে, তাহলে হাদিসের একটা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ থাকা উচিত ছিলো, যাতে যাবতীয় হাদিস লিপিকবদ্ধ থাকতো এবং জোর দাবি করা যেতো যে, কোনো হাদিস এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বাদ পড়েনি। নচেত ইসলামের উৎস অসম্পূর্ণ থাকলে স্বয়ং ইসলামের ও ঈমানের অসম্পূর্ণ থাকা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।

তাদের তৃতীয় আপত্তি হলো, যেসব হাদিস গ্রন্থ আমাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে বহুসংখ্যক হাদিসের শুদ্ধতা বা অশুদ্ধতা বিতর্কিত। কিছু হাদিস দুর্বল এবং কিছু হাদিস মনগড়া কৃত্রিম। অথচ কুরআনের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো বিতর্ক বা বিভ্রাট নেই এবং তার কোনো আয়াত দুর্বল বা কৃত্রিম নয়। যে জিনিস ইসলামের মৌলিক দলিল ও উৎস হবে, তার সম্পূর্ণ নিখুঁত ও নির্ভেজাল হওয়া অবশ্যক।

এই কটা আপত্তি ও অভিযোগের ভিত্তিতে হাদিসবিরোধী গোষ্ঠি যুক্তি দর্শায় যে, একমাত্র কুরআনকেই ইসলামের চূড়ান্ত সনদ ও উৎস বানানো আল্লাহর ইচ্ছে ছিলো বিধায় রসূল সা.কুরআনকে নিজের তত্ত্বাবধানে পূর্ণাঙ্গভাবে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছিলেন এবং আল্লাহ তাকে সর্ব প্রকারের  বিকৃতি ও খুঁত থেকে মুক্ত রেখেছেন। কিন্তু হাদিসকে ইসলামের উৎস বানানো আল্লাহর ইচ্ছে ছিলোনা। তাই আল্লাহ ও রসূল সা. তার সংরক্ষণের কোনো বিশেষ ব্যবস্থা করেননি।

উপরোক্ত আপত্তি ও অভিযোগ কয়টি যে বহুসংখ্যক বিভ্রান্তি ও প্রতারণার সমষ্টি, তা একটু চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথম আপত্তিটির মধ্য দিয়ে পাঠককে একটা মারাত্মক ভুল ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটি হলো, আজকাল কোনো শাসক বা আইন প্রণেতা যেমন সচরাচর নিজের জারিকৃত নির্দেশ বা আইন লিখিত বা মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করতে অভ্যস্ত ও বাধ্য থাকে, তেমনিভাবে আল্লাহ এবং তাঁর নবীগণও হয়তো নিজের নির্দেশনাবলীকে নির্ভরযোগ্য ও কার্যোপযোগী বানানোর জন্য তা যথারীতি লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য। বিশেষত, যেসব বিধানকে পুরুষাক্রমিকভাবে চিরদিনের জন্য অবশ্য পালনীয় করা প্রয়োজন। সেগুলোকে তো একটা গেজেটের মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত করতেই হবে। নচেত পৃথিবীতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

এই ধারণা ও চিন্তাধারা সর্বোতভাবে বাতিল, অযৌক্তিক ও অচল। এ ধারণা যদি সঠিক হতো, তাহলে আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর তাকে সর্বপ্রথম লেখা শেখাতেন। তারপর প্রত্যেক নবীর উপর হয় লিখিত নির্দেশ নাযিল করতেন, নতুবা নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে নেয়া তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক করে দিতেন। কিন্তু বিশ্বস্রষ্টা এ ধরণের কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করেছেন- এই মর্মে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়না এবং এর সপক্ষে কোনো যুক্তিও নেই। কুরআনের কোথাও বলা হয়নি যে, প্রত্যেক নবী এবং তাঁর উম্মতের লোকেরা সকল যুগেই লিখতে জানতো এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ প্রতিটি নির্দেশকে লিখিতভাবে নিজেদের কাছে সংরক্ষণ ও অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতো। পবিত্র কুরআনে হযরত ইবরাহীম আ. এর পূ্র্বে কোনো নবী কোনো কিতাব বা সহীফা (পুস্তিকা) পেয়েছেন বলে উল্লেখ নেই। হযরত ইবরাহীমের যুগ খৃষ্টপূর্ব দু'হাজার বছর বা তার চেয়েও আগে ছিলো বলে মনে করা হয়। কুরআনের পর অন্য  যে জিনিসটি হাদিসবিরোধী মহলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য  হতে পারে, সেটা হচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শন ও তথ্য। সেই ঐতিহাসিক নিদর্শন ও তথ্য থেকেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, মানুষ তার সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই এ কথাই জানা যায় যে, বর্ণমালা সদৃশ্য কিছু প্রতিকী নিদর্শনাবলী দ্বারা মনের ভাব প্রকাশের আদিমতম কৌশলটিও চার হাজার বছরের আগেকার মানুষের আয়ত্তে আসেনি। এখন প্রশ্ন জাগে, লিখিত হওয়াটাই যদি আল্লাহর ওহীর সংরক্ষণ ও বিশ্বাসযোগ্যতার একমাত্র ও অনিবার্য উপায় হয়ে থাকে, তাহলে যে যুগে মানুষ এ কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলো, তখন কি নবীগণ ও তাঁদের অনুসারীদের কাছে আল্লাহর বিধানের সংরক্ষিত থাকা ও অন্যদের কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার কোনো বিশ্বাসযোগ্য উপায় আদৌ ছিলনা?

তাছাড়া এমন পরিস্থির উদ্ভব হওয়াও বিচিত্র নয় যে, কোনো যুগে কোনো এক বা একাধিক মানবগোষ্ঠি লেখাপড়া শিখে ফেলেছিল, কিন্তু সামাজিক  ও পরিবেশগত যোগাযোগের অসুবিধার কারণে অন্যান্য জাতি তৎকালে বা তার পরবর্তী অবধি সেটা শিখতে পারেনি। অথচ কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছে, প্রত্যেক মানব গোষ্ঠির  কাছে পথপ্রদর্শক ও নবী রসূল প্রেরিত হয়েছেন। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, দুনিয়ার যে অংশের মানুষ লেখাপড়া জানতো এবং আল্লাহ তায়ালার ওহী লিপিবদ্ধ করে রেখেছিল, তাদের কাছে এবং তাদের বংশধরদের কাছেই শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বিধান পৌঁছানোর দায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়েছিল, আর যে অঞ্চলের মানুষ এবং যেখানকার নবী ও তাঁর অনুসারীরা নিরক্ষর ছিলো বিধায় ওহীকে লিপিবদ্ধ করতে সমর্থ হয়নি, সেসব জাতি ও তাদের পরবর্তী বংশধরের কাছে নবী আসা সত্ত্বেও আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াতের বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব যথোচিতভাবে পালিত হয়নি?

এ দিকটা বিচার বিবেচনা করলে স্বীকার না করে উপায় থাকেনা যে, রসূলের হাদিস তো দূরের কথা, খোদ আল্লাহর বাণীর বিশ্বাসযোগ্য ও অনুসরণযোগ্য হওয়ার জন্যও তার লিখিত হওয়া জরুরি নয়। বরঞ্চ রসূল সা.-এর তত্ত্বাবধানে তা লিপিবদ্ধ হবে, কি হবেনা, সেটা নির্ভর করে উক্ত নবী বা রসূলের আমলে বিরাজমান সুবিধা অসুবিধা এবং ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উপর। সেই পরিবেশ ও পরিস্থিতি যদি আল্লাহর কালাম ও রসূলের বাণী তথা হাদিসকে লিপিবদ্ধ করে রাখার সহায়ক ও অনুকূল না হয়, তাহলে লিপিবদ্ধ নাহলেও কোনো দোষ নেই। যতোক্ষণ ওহীকে কাগজের পাতায় সংরক্ষণের সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, ততোক্ষণ আল্লাহ তাকে মানুষের মন ও মস্তিষ্কে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। কুরআনের সব ওহী তো লিখিতভাবে নয়, বরং মৌখিকভাবেই নাযিল হতো। নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা রসূল সা.-এর মুখস্থ হয়ে যেতো। তারপর তিনি স্মৃতি থেকেই তা লিখাতেন। লেখার আগে ও পরে তা স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকতো।

এবার দ্বিতীয় অভিযোগের প্রসঙ্গে আসা যাক। অভিযোগটা হলো, হাদিসের সংগ্রহ অসম্পূর্ণ। এই অসম্পূর্ণ হাদিস শাস্ত্রকে যদি ইসলামি বিধানের উৎস গণ্য করা হয়, তাহলে তাতে ইসলামই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এর পয়লা জবাব হলো, হাদিসের যে সংকলন সংগ্রহ বর্তমানে আমাদের কাছে রয়েছে, কোনো জ্ঞানী ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি এই গোটা শাস্ত্রকে যদি ভক্তি শ্রদ্ধার মনোভাব ছাড়াই কেবল নিরপেক্ষ ও সুবিচারপূর্ণ দৃষ্টিতেও অধ্যায়ন করে, তাহলে এর অসম্পূর্ণতার অভিযোগ করাতো দূরের কথা, সে স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, পৃথিবীর কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জীবনবৃত্তান্ত, কথাবার্তা ও কার্যকলাপ এতো সুক্ষ্মদর্শিতার সাথে, এতো বিস্তারিত, নিখুঁত ও নিপুণভাবে কখনো সংকলন করা যায়নি, করা সম্ভবও নয়। সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন ও মুহাদ্দিসগণ রসূল সা.-এর জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে এতো বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে রেখে গেছেন যে, মানুষ তাকে অসম্পূর্ণ ভাবা তো দূরের কথা, অবাক বিস্ময়ে ভাবতে থাকে, এতো বেশি পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করা কিভাবে সম্ভব হলো। এইসব মহান ব্যক্তিবর্গ এক একটি হাদিস সংগ্রহ করার জন্য কিভাবে সম্ভব হলো। এইসব মহান ব্যক্তিবর্গ এক একটি হাদিস সংগ্রহ করার জন্য অথবা শুধুমাত্র তার সত্যতা যাচাই করার জন্য শত শত মাইল পথ ভ্রমণ করেছেন, নিজেদের গোটা জীবন এই কাজে নিয়োজিত করেছেন, এমনকি মৃত্যুর সময়ও এমন কোনো কোনো হাদিস বর্ণনা করে গেছেন, যার ধারণা ছিলো যে, হয়তো এটা আগে বর্ণনা করা সম্ভব হয়নি এবং তা মানুষকে না জানিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে হয়তো গুনাহ হবে। এমতাবস্থায় এ কথা কারো কল্পনা করা কঠিন যে, রসূল সা.-এর কথা ও কাজের কোনো অংশ হাদিস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ হতে বাদ পড়ে যেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমার বক্তব্য হলো, কোনো কথা ও কাজ যদি বর্ণনা থেকে বাদ পড়েও যেয়ে থাকে, তবে তাতে সামগ্রিকভাবে ইসলামের কোনো ক্ষতি হয়না। আল্লাহ কোনো প্রাণীকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো দায়িত্ব অর্পণ করেননা এবং তার যাবতীয় কাজের ভিত্তি তার নিয়ত তথা উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের উপর নির্ভরশীল। আমরা রসূল সা.-এর সুন্নাত তথা তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণকে ইসলামের উৎস মনে করার পরও যদি ইচ্ছাকৃত ও  উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তার কোনো অংশকে উপেক্ষা করি বা বাদ দেই, তাহলে আমাদের এ কাজটি যে আমদের ঈমান ও দীনদারীর পরিপন্থি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রসূল সা.-এর কোনো কথা বা কাজ যদি অনিচ্ছাকৃত: বাদ পড়ে যায় তাবে তাতে আমাদের ঈমানদারি ও দীনদারীর কোনো ক্ষতি হয়না। তবে সে জন্য শর্ত হলো, যেটুকু আমাদের কাছে সংগৃহীত রয়েছে, তাকে09ও যেনো অসম্পূর্ণতার অজুহাতে দিয়ে বর্জন না করি। কথাটা একটা উদাহরণ দিয়ে আরো পরিস্কার করা যেতে পারে। পবিত্র কুরআন সম্পর্কে তো কোনো কথাই উঠেনা। কারণ তার কোনো অংশ নষ্ট হয়নি এবং হবেওনা। কিন্তু পূর্বতন আসমানী কিতাবগুলোর ব্যাপার ভিন্ন। বেশ কয়েকটি আসমানী গ্রন্থ সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে হারিয়ে গেছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ সত্যটির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। বনী ইসরাইল এবং তাদের ধর্মীয় গ্রন্থসমূহের যে ইতিহাস আমরা জানি, তা থেকেও এ তথ্য অবগত হওয়া যায় যে, আসমানী গ্রন্থাবলীর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে তার অনুসারীদের শৈথিল্য ও উদাসিনতায় অমুসলিম হানাদারদের আগ্রাসন ও লুটতরাজ, অথবা যুগযুগান্তের আবর্তন বিবর্তন ও উত্থান পতনে সম্পূর্ণরূপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখানেও সেই একই প্রশ্ন জাগে। যাদের কাছে এইসব অসম্পূর্ণ ওহী বিদ্যমান ছিলো এবং এইসব দুর্যোগের পর যে সকল জাতির কাছে নতুন কোনো নবী আসেননি, নতুন আসমানী কিতাব আসেনি কিংবা জাতির হেদায়াত প্রাপ্তির উপায় কি ছিলো? এর পরিষ্কার জবাব এই যে, সেইসব জাতির কাছে কালের আবর্তন থেকে রক্ষা পাওয়া আসমানী কিতাবের যে অংশটুকু অবশিষ্ট ছিলো, সেটুকুই মেনে চলতে তারা আর্দিষ্ট ছিলো  এবং সেটুকুই তাদের হেদায়াত প্রাপ্তি ও মুক্তি লাভের জন্য যথেষ্ট ছিলো। তারা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে তার আনুগত্য করতে যদি কোনো ত্রুটি না করে থাকে তবে তাদের ঈমান ও দীনদারীতে কোনো অসম্পূর্ণতা নেই।

এখানে এ কথাও ভেবে দেখার মতো, কুরআনের আগে যে কিতাবগুলো নাযিল হয়েছিল, সেগুলোর শুধু যে অংশবিশেষ হারিয়ে গেছে তা নয়। বরং তাতে ব্যাখ্যা, নবীর কথা  ও কাজের বর্ণনা নবী ও তাঁর সহচরদের জীবনেতিহাস, সমকালীন ঘটনাবলীর ইতিবৃত্ত এবং শরিয়তের বিধান ইত্যাদি যত্রতত্র সংযুক্ত ও মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে গেছে। যে ভাষায় সেই সব আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছিল এবং লিখিত হয়েছিল, তার মূল লিপি নিশ্চিহ্ন হয়ে  গিয়েছিল এবং সময় সময় কেবলমাত্র অনুবাদ ও তথ্য অনুবাদ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। এভাবে ঐসব আসমানী কিতাব শুধু অসম্পূর্ণই থেকে যায়নি, বরং একেবারেই বিকৃত হয়ে গেছে। এমনকি তার অনুসারীদের কাছে তা শোধরানোর কোনো উপায়ও ছিলনা। মুহাম্মদ সা. নবুয়ত লাভের অব্যবহিত পূর্বে ইহুদি ও খৃষ্টানরা যে তাওরাত ও ইঞ্জিলের অনুসরণ করে চলছিল, তাতে কুরআনের বর্ণনা এবং আহলে কিতাব গোষ্ঠিদ্বয়ের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অত্যন্ত নৈরাজ্যজনক পর্যায়ে বিকৃতি ঘটে গিয়েছিল। এমনকি ইহুদি ও খৃষ্টানদের কাছেই এ রহস্য দুর্বোধ্য হয়ে দাড়িয়েছিল যে, তাওরাত ও ইঞ্জিল যদি সত্যিই আল্লাহর কালাম হয়ে থাকে এবং হযরত মুসা ও হযরত ঈসার জীবদ্দশাতেই তাদের উপর নাযিল হয়ে থাকে, তাহলে তাতে হযরত মুসার ইন্তিকাল ও হযরত ঈসার শূলে চড়ার বিবরণ কিভাবে স্থান পেলো? কিন্তু তবুও একথা কেউ অস্বীকার করতে পারেনা যে, রসূল সা.-এর নবুওয়ত লাভ ও কুরআন নাযিল হওয়ার আগে এই গ্রন্থ দু'টিই তাদের জন্য আল্লাহর বিধান ও হেদায়াত লাভের একমাত্র উৎস ছিলো। আল্লাহর কথা, রসূলের কথা এবং পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের চিন্তা ও গবেষণাপ্রসূত শরিয়তবিধি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এই অজুহাতে তখন ঐ দুইখানা আসমানী গ্রন্থকে শরিয়তের উৎস বলে কেউ অস্বীকার করেনি। আমাদের তো আল্লাহর লাখ লাখ শোকর আদায় করা উচিত যে, আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আমাদের ক্ষেত্রে এমন উদ্বেগজনক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। আমাদের সমাজে শুরু থেকেই কুরআন, তাফসির, হাদিস ফিকাহ সবকিছুই পৃথক পৃথকভাবে আসল ও অবিকৃত অবস্থায় বহাল রয়েছে।

হাদিস বিরোধী মহলের মনে রসূল সা.-এর হাদিস ও সুন্নতের প্রতি যে অন্ধ বিদ্বেষ বিরাজমান, তারা যদি কিছুক্ষণের জন্য তার ঊর্দ্ধে উঠতে পারেন এবং উপরোক্ত তথ্যগুলো বিবেচনা করেন, তাহলে তারা তার ভেতরেই তাদের তৃতীয় ও সর্বশেষ অভিযোগের জবাবও পেয়ে যেতে পারেন। তথাপি আমি এই তৃতীয় অভিযোগ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলাছি। এ কথা সত্য, বিদ্যমান হাদিস গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের হাদিসের সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সেগুলোর ভেতরে পার্থক্য করা কষ্টকর হয়ে গেছে। যে ব্যক্তি হাদিস শাস্ত্র সম্পর্কে কিছু জ্ঞান রাখে, তার কাছে এটা সুবিদিত যে, হাদিস শাস্ত্রবিদগণ সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদিস দুর্বল ও কৃত্রিম হাদিস থেকে বাছাই করে পৃথক করে দিয়েছেন। সেই সাথে তারা হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধ বাছবিচারের নীতিমালা এবং বিধিসমূহও রচনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো জাতি এমন সুক্ষ্ম তাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও যাঁচাই বাছাইর উদাহরণ পেশ করতে পারবেনা। এসব বিধির আলোকে প্রত্যেক হাদিস শিক্ষার্থী বুঝে নিতে পারে যে, হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধ কোন কোন যুক্তিপ্রমাণের কষ্টিপাথরে নিরূপণ করা হয়েছে এবং তা কতোখানি নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী। হাদিস শাস্ত্রকারদের এমন বিষ্ময়কর কৃতিত্ব ও নৈপুণ্য ছাড়াই যদি গোটা হাদিস সংকলন জড়াখিচুড়ি আকারে আমাদের হাতে আসতো এবং আমাদের কাছে শুদ্ধ হাদিসকে অশুদ্ধ হাদিস থেকে বাছাই করার কোনো নিক্তি না থাকতো, তাহলে অবশ্য ব্যাপারটা উদ্বেগজনক হতে পারতো। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বিচলিত হবার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। আরো আনন্দের ব্যাপার, যেসব হাদিসের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা সম্পর্কে মুসলিম জাতির সংখ্যাগুরু সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, তার সংখ্যা বিতর্কিত হাদিসগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এমতাবস্থায় কেউ যদি একটি ক্ষুদ্র অংশকে সন্দেহজনক মনে করে সমগ্র হাদিস শাস্ত্রকে অবিশ্বাসযোগ্য আখ্যায়িত করে, তবে তার এ কাজটি হবে গুটিকয় অচল বা জাল মুদ্রা থাকার কারণে সমগ্র কোষাগারে বা দেশে যতো মুদ্রা চালু রয়েছে, তার সবগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, সমুদ্রে নিক্ষেপ করা বা অচল ঘোষনা করার ন্যায়। কোনো বুদ্ধিমান ও সুস্থ্য মুস্তিষ্কের মানুষ কি এমন অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা কল্পনাও করতে পারে? [তরজমানুল কুরআন, নভেম্বর, ডিসেম্বর ১৯৬৪]

লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   (Copy Write)

Share this :

Previous
Next Post »