Islamic World ..................
প্রশ্ন : রসূল সা.-এর পবিত্র জীবন বৃত্তান্ত ও মহৎ চরিত্রের যে বিস্তৃত বিবরণ হাদিসের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ করতে পারেনা। আর এই সুবিশাল হাদিস ভাণ্ডার থেকে উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে তা বাদ দেয়া বা পাইকারিভাবে অস্বীকার করাও কোনো মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একটি মহলের বক্তব্য হলো, আমরা শুধু সহীহ বিশুদ্ধ হাদিসগুলোই মানি। সহীহ হাদিসের মাপকাঠি তাদের কাছে এই যে, তা যেনো কুরআনের পরিপন্থি ও সাধারণ বিবেকবুদ্ধির বিরোধী না হয়। তারা আরো বলেন, রসূল সা. এক দিক দিয়ে আল্লাহর প্রেরিত রসূল ছিলেন, আবার আর এক হিসেবে তিনি জাতির নেতা ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি ছিলেন। আল্লাহর রসূল হিসেবে তাঁর যে মহৎ চরিত্র ও আদর্শ কার্যধারা আবশ্যিকভাবে চিরদিনের জন্য অনুকরণীয়, তা কুরআনে সংরক্ষিত হয়েছে। সুন্নত বলতে যদি কিছু থেকেই থাকে তবে তা কুরআনে সন্নিবেশিত রসূলের এই আদর্শ কার্যধারা ও চরিত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এ ছাড়া তাঁর আর যেসব কথা ও কাজের বিবরণ পাওয়া যায়, তা সমাজ নেতা ও সমসাময়িক রাষ্ট্রনায়কের কথা ও কাজের চেয়ে বেশি কোনো গুরুত্ব রাখেনা। সমাজ নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর আদেশ নিষেধ শুধুমাত্র তাঁর জীবদ্দশায় যারা তাঁর অনুসারী তথা সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন তাঁদের জন্যই অবশ্য পালণীয়। পরবর্তীকালের মুসলমানদের জন্য তাঁর নির্দেশাবলী ও সিদ্ধান্তসমূহ নিছক ইসলামের দৃষ্টান্তস্বরূপ। তার হুবুগু আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য নয়। মূলত যে আনুগত্য ইসলামের দৃষ্টিতে কাংখিত, তা হচ্ছে কুরআনী বিধান অনুসারে প্রতিষ্ঠিত সমসাময়িক সরকার ও প্রশাসকমণ্ডলীর আনুগত্য। এসব শাসক ও প্রশাসকের এখতিয়ার রয়েছে যে, ইচ্ছে হলে হুবুহু রসূল সা.-এর নির্দেশ নিজেরাও মেনে চলবেন এবং দেশবাসীকেও মানতে বাধ্য করবেন, নতুবা তাতে রদবদল করে নতুন নির্দেশমালা প্রণয়ন করবেন।
রসূল সা.-এর কথা ও কাজের যে অংশের বিবরণ কুরআনে নেই, সে অংশটি শুধুমাত্র রসূল সা.-এর আমলেই অনুকরণযোগ্য, তার পরে নয়। এ বক্তব্যের সপক্ষে এই মহলটি বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকে। যেমন, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূল সা, স্বয়ং নিজের মানবীয় দিক ও নবীসুলভ দিককে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে বলেছিলেন যে, একজন মানুষ হিসেবে তিনি যা কিছু বলেন বা করেন, তা অনুসরণ করা জরুরি নয়। খোলাফায়ে রাশেদীনও বহু ব্যাপারে রসূল সা.-এর কার্যধারার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। বিশেষত হযরত ওমর প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটি সিদ্ধান্ত এমন কার্যকর করেন, যা রসূল সা. করেননি। শোনা যায়, ইমাম আবু হানিফাও ফেকাহ শাস্ত্র রচনায় হাদিসের সাহায্য নেননি। তাঁকে সহীহ হাদিস অবহিত করলেও তিনি হয় রহিত, নচেৎ অচল বলে অগ্রাহ্য করতেন এবং বলতেন, এসব নির্দেশ রসূল সা.-এর আমলে আরব জাতির জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। এগুলো হুবুহু কার্যকরী করা অন্যদের জন্য জরুরি নয়। শাহ ওয়ালী উল্লাহও এরূপ নীতি অনুসরণ করতেন বলে জানা যায়। এ মহলটি কুরআনী চিন্তাধারার ধারক বাহক বলে পরিচিত এবং তাদের মতামত আমি সংক্ষেপে আপনাকে অবহিত করলাম। আমার জিজ্ঞাসা এই যে, এই মতামত ও চিন্তাধারা হাদিস অমান্য করার সমর্থক কিনা? রসূলের নির্দেশাবলীকে শুধুমাত্র রসূলের জীবনকালেই অনুকরণীয় মনে করা এবং উল্লেখিত প্রাচীন মুসলিম মনীষীগণও এরূপ মনে করতেন বলে বিশ্বাস করা সঠিক কিনা?
জবাব : আপনি স্বীয় চিঠিতে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, সেগুলো নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত আলোচনা করা সংক্ষিপ্ত চিঠির আকারে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সুদীর্ঘ নিবদ্ধ অথবা সুপরিসর গ্রন্থ রচনা। আল্লাহর শোকর যে, বিশিষ্ট আলেমগণ বিস্তৃত নিবদ্ধ ও বইপুস্তক লিখে প্রয়োজন অনেকাংশে পূর্ণ করে দিয়েছেন। তাই আমি শুধু আপনার চিঠির দাবি অনুসারে এ সংক্রান্ত কিছু নীতি বক্তব্য পেশ করবো। সর্বপ্রথম কথা এই যে, যারা মনে করেন, রসূল সা. স্বীয় কথা থাকলে তার অনুসরণ করা কেবল তাঁর জীবদ্দশায় সাহাবাদের জন্যই বাধ্যতামূলক। এর অর্থ দাঁড়ায় তাদের মতে হাদিস স্বীকার করা আর অস্বীকার করা একই কথা। তারা নিজেদের মনগড়া মাপকাঠিতে যাচাই করে যদি কোনো হাদিসকে সহীহ এবং কুরআন ও বিবেকবুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেনও, তবে তার বাস্তব ফল এর চেয়ে বেশি কিছু হবেনা যে, তাঁরা ঐ হাদিসকে কেবল বিশুদ্ধ মেনে নিয়েই ক্ষান্ত থাকবেন। তারা বড়জোর এই বলে একটি বাস্তবতার স্বীকৃতি দেবেন যে, 'দি ক্যাপিটাল' কার্লমার্কসের লেখা বই, বা ' আরমাগানে হিজায' ইকবালের একটি কাব্য গ্রন্থ বলে কেউ একটি বাস্তবতার স্বীকৃতি দিলো। এরপর প্রশ্ন ওঠে যে, একটা জিনিসকে সত্য ও সঠিক বলে মেনে নেয়ার পর তার বাস্তব অনুসরণ করা হবে কিনা, এ প্রশ্ন উভয় ক্ষেত্রেই অবান্তর। বড়জোর তারা ততোদূরও যেতে পারেন যে, 'রাষ্ট্রনায়ক' বা 'জাতির নেতা' যদি হাদিসটিকে কার্যোপযোগী মনে করে তার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তাহলে হাদিসটি অনুসারে তারা কাজও করতে ইচ্ছুক হবেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও হাদিসের আনুগত্য এ জন্য করা হবেনা যে, ওটা রসূলের কথা বা কাজের বাহন। বরং 'রাষ্ট্রনায়ক' তার মঞ্জুরি দিয়েছেন ও আমলযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন বলেই তার আনুগত্য করা হবে। রাষ্ট্রনায়ক যদি হাদিসকে না-মঞ্জুর কিংবা সংশোধনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তাহলে তারা বড়জোর এতোটুকু করবেন যে, সহীহ হাদিসটিতেও একটা ঐতিহাসিক কীর্তি হিসেবে মেনে নিয়ে অন্যান্য ঐতিহাসিক কীর্তির ন্যায় নির্দিষ্ট সংরক্ষণাগারে রেখে দেবেন। কেননা ইতিহাস চাই আলেকজান্ডার কিংবা নেপোলিয়নের হোক, চাই আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ সা.-এর হোক, তা ইতিহাসই। তার অনুসরণ করার তো কোনো বাধ্যবাধকতা থাকেনা।
আমার মতে, এই মহান তত্ত্বের প্রবক্তাদের হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করার জন্য তাত্ত্বিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক মাপকাঠি সংগ্রহ করার এতো ঝামেলা পোহানোর কোনো প্রয়োজন ছিলনা। তারা বরঞ্চ একটা কথার উপরই অনড় হয়ে থাকলে পারতেন। সে কথাটি হলো, তাদের কথিত 'কুরআনি সরকার' যে হাদিসকে স্বীকৃতি দেবে, সেটাই চলবে। আর যে হাদিসকে সেই সরকার সমকালীন পরিস্থিতি ও বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করবে, সে হাদিস অচল মুদ্রার মতো টাকশালের বাইরে নিক্ষিপ্তি হবে। তবে যদি মতলবখানা এই হয়ে থাকে যে, হাদিস অমান্য করার গুরুতর দায় এড়ানো এবং মুসলিম গণরোধ থেকে বাঁচার জন্য তারা মুখে হাদিসের স্বীকৃতি দান এবং কাজে তা অস্বীকার করার ফন্দি এঁটে থাকেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
রসূল সা.-এর আদেশ ও নিষেধ, তাঁর ফরমান ও সিদ্ধান্ত এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে দেয়া তাঁর নির্দেশাবলী মেনে চলার বাধ্যবাধকতা শুধুমাত্র রসূল সা.-এর জীবদ্দশা পর্যন্ত সীমিত করার জন্য এ মহলটি রসূলের রিসালাত ও শাসকসূলভ মর্যাদার মধ্যে বিভেদ রেখা টানার পক্ষে যে বক্তব্য দিয়েছে, সেটাও একটা নিরর্থক ভাওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়। এ কথা তো অবিসংবাদিতভাবে সত্য যে, রসূল সা. মুসলমানদের শাসক এবং রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন, বিচারকও ছিলেন, সেনাপতিও ছিলেন এবং আরো বহু দিক দিয়ে তিনি মুসলমানদের নেতা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন। কিন্তু নবী ব্যক্তিত্বের এইসব দিকগুলো আসলে তার রসূলসূলভ পদমর্যাদারই বিভিন্ন দিক ও বিভাগ। এগুলোর একটিকে অপরটি থেকে আলাদা করা এবং একটিকে চিরস্থায়ী ও অপরটিকে অস্থায়ী আখ্যায়িত করার চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বাতলি ও অযৌক্তিক। এসব রকমারি মর্যাদা ও ভূমিকার মধ্যে দিয়েই রিসালাতের দায়িত্ব ও রসূলসূলভ তৎপরতার বিকাশ ও স্ফূরণ ঘটেছে। প্রতিটি ভূমিকায় রিসালাতের মাহাত্ম্য প্রতিফলিত এবং নবুওয়াতের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে। এগুলোর কোনটিতে নবুওয়ত ও রিসালাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে নবুওয়াত ও রিসালাত কাকে বলে, সেটাই বুঝা মুশকিল হয়ে পড়বে। এসকল ভূমিকায় রসূল সা. যেসব উল্লেখযোগ্য কর্ম সম্পাদন করেছেন, তার সবই প্রকৃতপক্ষে রিসালাতের দায়িত্ব পালনেরই বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় বিশেষ। এ সমস্ত তৎপরতা ও ভূমিকাকে কুরআন ও হাদিস উভয়টিতেই এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একটি অপরটির সাথে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ও অবিচ্ছেদ্য, তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। সেখানে রিসালাত ও রাষ্ট্রনায়কত্বের মাঝে কোনো বিভক্তি রেখা যেমন টানা হয়নি, তেমনি এমন তত্ত্বও উপস্থাপন করা হয়নি যে, মুহাম্মদ সা.-এর যেসব কথা ও কাজ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে কেবল সেগুলোই তাঁর সুন্নত ও অনুকরণীয় আদর্শ এবং কেবলমাত্র সেগুলোরই আনুগত্য করা চিরস্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক। কুরআনের বাইরে যদি রসূল সা.-এর কোনো কথা ও কাজের বিবরণ থেকে থাকে, তবে তাকে তাঁর সুন্নত ও আদর্শ বলা যাবেনা, বরং সেটা কেবল একজন নেতা ও শাসকের কথা ও কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তা তার শাসনামল অতিক্রান্ত হওয়ার পর আর অনুকরণযোগ্য থাকবেনা। এখানে এটাও লক্ষণীয় যে, শুধু কুরআনকেও যদি মানা হয়, তাহলে এতেও রসূল সা.-এর অনুকরণীয় জীবনাদর্শের এমন বহু দিক আলোচিত হয়েছে, যা তাঁর শাসকসূলভ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বলা যায়। এখন যদি রসূল সা.-এর শাসকসূলভ পদমর্যাদার কর্তব্য ও অধিকারকে রসূলসূলভ পদমর্যাদা থেকে আলাদা করে পূর্বোক্তগুলোকে সাময়িক ও অস্থায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে একথা না মেনে উপায় থাকেনা যে, নবী জীবনের নেতৃত্ব- কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা সংক্রান্ত যেসব শিক্ষা খোদ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, তাও মেনে চলার কোনো চিরস্থায়ী বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ এ ধারণা একেবারেই বাতিল, অন্যায় এবং স্বয়ং কুরআনেই সুস্পষ্ট ঘোষণার পরিপন্থি। যারা এই বিভেদ নীতির প্রবক্তা, এটা তাদেরও সেই চিন্তাধারার বিরোধী, যার আওতায় তারা অনুগ্রহ করে কুরআন বর্ণিত নবী জীবনকে আদর্শকে 'সুন্নতে রসূল' বলে মানেন এবং নিজেরাও তা মেনে চলতে চান।
এবার যেসব যুক্তি প্রমাণের আলোকে তারা রসূল সা.-এর রসূলসূলভ ও শাসকসূলভ ভূমিকায় পার্থক্য করেন, সেই যুক্তি প্রমাণগুলো কতদূর ধোপে টেকে, তা খতিয়ে দেখা যাক্ তাঁরা একটি যুক্তি দেখান এই যে, হাদিসে রসূল সা. স্বয়ং তার মানবসূলভ ও নবীসূলভ মর্যাদায় পার্থক্যের কথা বলে কিছু কিছু ব্যাপারে তাঁর আনুগত্য থেকে আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন ও স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছেন। আমি জেনে আনন্দিত হলাম যে, তারা এ সংক্রান্ত দু'একটা হাদিসকে অন্তত সহীহ মেনে নিয়ে তা দ্বারা ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি বুঝতে অক্ষম, এসব হাদিস দ্বারা রসূল সা.-এর রিসালাত ও রাষ্ট্রনায়কত্বের মাঝে বিভাজন রেখা টেনে একটিকে স্থায়ী ও অপরটিকে সাময়িক আখ্যায়িত করার তত্ত্বটি কিভাবে সঠিক প্রমাণিত হয়। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, রসূল সা.-এর মানবীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং পথপ্রদর্শক সূলভ ও শাসকসূলভ দায়িত্ব পালনকালে ঘোষিত নির্দেশাবলী ও উক্তিসমূহ কি একই ধরণের? একথা সত্য যে, রসূল সা. দ্বারা কখনো কখনো কিছু একান্ত মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও ব্যতিক্রমধর্মী স্বভাবসূলভ কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে, যার আনুগত্য করা আমাদের জন্য শরিয়ত অনুযায়ী বাধ্যতামূলক নয় কিন্তু এই ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনাবলীর আলোকে এরূপ সাধারণ মূলনীতি উদ্ভাবন করা কি কোনো মুসলমানের পক্ষে সম্ভভ যে, রসূল সা. মুসলমানদের নেতা, পথপ্রদর্শক, শিক্ষাগুরু ও শাসক হিসেবে সমগ্র জীবনব্যাপী যে অবদান ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তার কোনো কিছুই আর আমাদের জন্য অবশ্য পালনীয় নয়? অথচ তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ শুধু সাহাবায়ে কিরামকে নয় বরং অনাগত কালের সকল মুসলমানকেই দেয়া হয়েছে।১
________________________________
১. এ ধরণের নির্দেশ সম্বলিত হাদিস অনেক রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, "তোমরা আমার মৃত্যুর পর অমুক অমুক ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে অমুক অমুক কর্মপন্থা অবলম্বনা করবে।" যেসব হাদিস গ্রন্থ থেকে রসূলের নবীসূলভ মর্যাদা ও মানবসূলভ মর্যাদা সংক্রান্ত হাদিসগুলোর উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে, এসব হাদিস সেইসব গ্রন্থেই রয়েছে। এসব হাদিসের 'গুরুত্ব ও উপকারিতা' সম্পর্কে হাদিস অমান্যকারী মহলের অভিমত কি, তা অবশ্য জানা যায়নি।
রসূল সা.-এর নির্দেশাবলীকে অস্থায়ী ও সাময়িক প্রমাণ করার জন্য আরো একটা যুক্তি দেয়া হয়েছে এই যে, খোলাফায়ে রাশেদীন বহু ক্ষেত্রে রসূল সা.-এর আদেশের পরিপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে হযরত ওমরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও আমাকে দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে, এ অভিযোগ আরোপ করার সময়ও ঘটনাবলীর একপাশে ও বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরে একটা ব্যতিক্রমী বিষয়কে সাধারণ নিয়ম হিসেবে বড় করে দেখোনো হয়েছে। কতিপয় অভিজ্ঞ আলেম এ ধরণের ঘটনাবলীকে একত্র করে ও সেগুলোর বিশদ বিবরণ দিয়ে এ অভিযোগের রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছেন। তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, খোলাফায়ে রাশেদীন রসূল সা.-এর সুন্নত থেকে চুল পরিমাণও বিচ্যুত হননি। যে বিষয়গুলোকে হযরত ওমরের নতুন উদ্যোগ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে হয় কুরআন ও হাদিসে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিলনা, নচেত থাকলেও তাতে এতো প্রশস্ততা ছিলো যে, তার বাস্তবায়নে একাধিক কর্মপন্থা অবলম্বনের অবকাশ ছিলো।
এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ও বিশ্লেষণ আমি দিতে চাইনা। তার পরিবর্তে আমি আশা করবো যে, আপনি তথাকথিত কুরআনি চিন্তাধারার প্রবক্তাদের কাছেই জিজ্ঞেস করবেন, যেসব গ্রন্থে তারা খোলাফায়ে রাশেদীনের এইসব কল্পিত সুন্নত বিরোধী তৎপরতা খুঁজে হিমসিম খাচ্ছেন, সেখানে কি তারা এমন তথ্যও দেখতে পাননি যে, এই খোলাফায়ে রাশেদীনই খেলাফতের বাইয়াত তথা অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় এই বলে অঙ্গীকার করতেন : সব সময় আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নত পদক্ষেপ নেবো? শুধু তাই নয়, খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের প্রত্যেকে প্রকাশ্য জনসমাবেশে মুসলমানদেরকে বলতেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমরা কেবল ততোক্ষণ আমার কথামত চলবে যতোক্ষণ আমি আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করবো, তখন আর আমার কথামত চলতে তোমরা বাধ্য থাকবেনা।"
এসব খলিফার সামনে যখনই কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিতো। তারা প্রথমে আল্লাহর কিতাবের এবং তার পরে নিজেদের জানামতে রসূলের হাদিসের শরণাপন্ন হতেন। নিজের জ্ঞানে না কুলালে মজলিসে শূরার সদস্যদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন যে, আপনাদের কারো কাছে রসূল সা.-এর এমন কোনো উক্তি জানা আছে কিনা, যার আলোকে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। সেখানেও যদি প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা না পাওয়া যেতো, তাহলে সর্বস্তরের মুসলিম জনগণের মধ্যে ঘোষণা করে দেয়া হতো যে, অমুক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। এ সম্পর্কে রসূল সা.-এর কোনো ফরমান কারে জানা থাকলে সে যেনো তা অবিলম্বে জানায়। এভাবে কারো কাছে রসূল সা.-এর কোনো ফরমান পাওয়া গেলে খলিফা তৎক্ষণাৎ বলে উঠতেন :
------------------------------------------------------
"আল্লাহর শোকর, তিনি আমাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি রেখেছেন, যিনি ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণে তৎপর।"
সেই সাথে সত্যনিষ্ঠ খলিফা নিজের অজ্ঞতার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে বলতেন :
-------------------------------------
"ব্যবসায়ের ব্যস্ততা আমাকে অজ্ঞতায় নিমজ্জিত রেখেছে।"১
এমনকি ক্ষমতাসীন খলিফা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন এবং তারপর রসূল সা.-এর কোনো দৃষ্টান্ত অবগত হতেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে আল্লাহর শোকর আদায় করতেন যে, অজ্ঞতাবশত রসূল সা.-এর একটি নির্দেশ লংঘন থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন। প্রাদেশিক গভর্ণর, বিচারক ও শিক্ষকগণকে এই মর্মে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে দায়িত্ব নিয়োগ করা হতো যে, প্রথমে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে করণীয় খুঁজে নেবে। সেখানে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনার সন্ধান না পেলে বিবেকবুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে পাওয়া মূলনীতি ও চেতনার আলোকে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা উদ্ভাবন (এক কথায় 'ইজতিহাদ') করবে। এ ধরণের বর্ণনা হাদিসগ্রন্থ, সীরাতগ্রন্থ ও ইসলামি ইতিহাস গ্রন্থসমূহে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এবং একই গ্রন্থে বারংবার রয়েছে। এগুলোকে উপেক্ষা করে কেউ যদি কেবল নিজের মতলব সিদ্ধির সহায়ক ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোকেই খুঁজে বেড়ায় তবে তার তুলনা এমন ব্যক্তির সাথেই করা যায়, যে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে রক্ষিত মাইলফলক দেখতে পায়না, অথচ অন্ধকার কক্ষে কোনো ক্ষুদ্র কণিকাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায়। সত্যানুসন্ধানীদের রীতি এটা নয় যে, তারা প্রথমে নিজেদের ইচ্ছেমত একটা মতবাদ বানিয়ে নেবে, অতপর তার সপক্ষে কোথাও একটা তিল পাওয়া গেলেও তাকে তাল বানিয়ে দেখবে আর বিপক্ষে কোথাও পাহাড় সমান প্রমাণ পাওয়া গেলেও তার অস্তিত্বই অস্বীকার করবে। যারা বড় গলায় দাবি করেন, কুরআনের দলিল ছাড়া আমরা মুখে গ্রাস তোলারও সাহস করিনা। তাদের আপন দাবির কিছুটা তো সম্মান রাখা উচিত।
যাহোক, যে ব্যক্তি বাস্তব ঘটনাকে নিজের মর্জি মোতাবেক সাজানোর রোগে আক্রান্ত নয়, সে খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন বৃত্তান্ত পড়ে কখনো এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনা যে, এসব খলিফা নিজেদেরকে রসূলের প্রতিষ্ঠিত আদর্শ ও তথা সুন্নাহ অনুসরণে বাধ্য মনে করতেননা, বা তার বিরুদ্ধে চলার এখতিয়ার রাখেন বলে মনে করতেন। এ অভিযোগটা
____________________
১. এটি হযরত ওমরের উক্তি।
বিশেষভাবে হযরত ওমরের বিরুদ্ধে আরোপ করা হয় এবং তাঁর চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটা সিদ্ধান্তকে এর প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়। অথচ হযরত ওমরের শাসনামলে প্রায় দশ বছর ছিলো এবং এই মেয়াদকাল তিনি শত শত কোনো হাজার হাজার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বলবৎ করেছেন বললে অত্যুক্তি হবেনা। এর মধ্যে থেকে মাত্র চল্লিশ বা পঞ্চাশটা সিদ্ধান্ত যদি এমন পাওয়া যায়, যা আপাত দৃষ্টিতে রসূলের সুন্নাহের পরিপন্থি বলে মনে হয়। তাহলে প্রথমত এটা এই অভিযোগের দুর্বলতাই প্রমাণ করে। উপরন্তু যখন দেখা যায়, এ কয়টা উদাহরণ দ্বারাও বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য অস্বাভাবিক রকমের ঘুরপ্যাচের আশ্রয় নেয়া হয়েছে এবং জেনেশুনে তার সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে বা ঘটনাকে বিকৃত করে সুন্নাহর আনুগত্যের বিরুদ্ধাচরণ বানিয়ে দেখানো হয়েছে, তখন তথাকথিত এই সব 'কুরআনী চিন্তাধারা'র প্রবক্তাদের সততার প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার জন্মে। আমি এখানে নমুনাস্বরূপ মাত্র একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি। হযরত ওমর সম্পর্কে এই মহলটি বলে থাকে, তিনি তওয়াফের সময় ঘাড় দুলিয়ে চলা জরুরি মনে করতেননা। কেননা রসূল সা. তো শুধুমাত্র প্রতাপ ও বিক্রম প্রদর্শন ও কাফেরদেরকে শংকিত করার উদ্দেশ্যেই এ নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন। ইসলামে বিজয়ী হয়ে যাওয়ার পর তার আর দরকার নেই।
এখন দেখুন, সহীহ হাদিসে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সেটা এই যে, হযরত ওমর 'রামাল' অর্থাৎ ঘাড় দোলানো পরিত্যাগ করার ইচ্ছে করেছিলেন সত্য। কেননা বাহ্যত তার প্রয়োজন অবশিষ্ট ছিলনা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে ভিন্ন চিন্তার উদয় হলো এবং তিনি বললেন :
-----------------------------------------------------
"রসূল সা. যে কাজ করেছেন, তা ত্যাগ করা আমরা পছন্দ করিনা।"
বুখারির হজ্জ সংক্রান্ত অধ্যায়ে এ ঘটনার বিস্তরিত বিবরণ রয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সম্পর্কে হাদিস অস্বীকারকারী মহল অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারণা চালিয়ে থাকে যে, তিনিও নাকি হাদিস মানতেন না এবং তাঁর গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা থেকে তারা হাদিসের অগ্রাহ্যতার পক্ষে যুক্তিপ্রমাণ যোগাড় করার চেষ্টা করতে অভ্যস্ত। অথচ সেই শাহ ওয়ালিউল্লাহর হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাতে এই ঘটনা উদ্ধৃত করার পর তিনি লেখেন : "হযরত ওমর রামাল ত্যাগ করতে চেয়োছিলেন এই যুক্তির ভিত্তিতে যে, ওটা যে কারণে প্রবর্তিত হয়েছিল তা আর অবশিষ্ট ছিলনা। কিন্তু ---------------------------------- পরক্ষণেই ওমর ভয় পেয়ে গেলেন এবং ভাবলেন, এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে, যা তাঁর জানা নেই।"
ভাবতে অবাক লাগে, যে ওমর রা. সুন্নতের ব্যাপারে এতো সতর্ক ও সচেতন ছিলেন যে, দৌড়ানোর সময় বিশেষ ধরণের ঘাড় দোলানোকে পর্যন্ত বদলাতে সাহস পাননি এবং শংকিত ছিলেন যে, খোদা না করুন, এতে রসূল সা.-এর বিরুদ্ধাচারণের দায়ে দোষী হয়ে যেতে হয় কিনা, সেই ওমর রা.-এর উপর সুন্নত পরিত্যাগ এবং সুন্নতের রদবদল বা রহিতকরণের অভিযোগ আরোপ করা হচ্ছে!১
হযরত ওমর রা. ও অন্যান্য খোলাফায়ে রাশেদীনের পর ইমাম আবু হানিফার বিরুদ্ধে সুন্নাহ বর্জন ও হাদিস অগ্রাহ্য করার যে দোষারোপ করা হয়, তার অবস্থাও তদ্রুপ। সত্য ও বাস্তবতার সাতে তার দূরতম সম্পর্ক নেই। আলেম সমাজ এ অভিযোগের বিশদ জবাব দিয়ে তা খণ্ডন করেছেন। আমি এ ব্যাপারে শুধু এতোটুকু কথাই বলবো, ইমাম আবু হানিফা ফিকাহ শাস্ত্রের সংকলন ও প্রণয়নে যে অবদান রেখে গেছেন এবং হাদিস সম্পর্কে তাঁর যে অবস্থান ছিলো, তা ইতিহাসের কোনো হারানো অধ্যায় নয় যে, ইতিহাস ও কাব্য গ্রন্থে নতুন করে তার সন্ধান চালানোর চেষ্টা করতে হবে। উপরন্তু কোনো ব্যক্তির মতামত জানার এটা কোনো সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত পন্থা নয় যে, সেই ব্যক্তি নিজে এবং তাঁর শিষ্য ও ভক্তরা তাঁর মতামতকে যেভাবে তুলে ধরেন, তা উপেক্ষা করে যারা তাঁর বিরোধিতার মনোভাব বা তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে এবং সঠিকভাবে তাঁর মতামত জানেওনা, তাদের কাছ থেকে তার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এ কথা সত্য, ইমাম সাহেবের ইজতিহাদী কর্মে হাদিসের দুর্বলতা ও বিশুদ্ধতা যাঁচাই এবং হাদিসের স্বল্পতা ও কিয়াসের আধিক্য সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বিতর্ক আগেও ছিলো, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু তাঁর হাদিস অস্বীকারের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেনা, কিংবা এমন অপবাদও তাঁর উপর আরোপ করতে পারেনা যে, সহীহ হাদিসকেও তিনি এই বলে প্রত্যাখ্যান করতেন যে, এর প্রয়োগের সময় বাসি হয়ে গেছে। যে ইমামের ঘোষণা ছিলো : "যখন কোনো ব্যাপারে সহীহ হাদিস পাওয়া যাবে তখন সেটাই হবে আমার নীতি" এবং যিনি বলতেন যে :
------------------------------------
"হাদিস যদি না থাকতো তবে আমরা কেউ কুরআন বুঝতে পারতাম না।"
এবং "-----------------------------------"
________________
১. এটা হযরত ওমরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের কারসাজিও হতে পারে। কেননা তিনি হাদিস অমান্য করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে আগাম হুশিয়ারি উচ্চারণ করে গেছেন। সুনানে দারামীতে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন : কিছু লোক আবির্ভূত হবে, যারা কুরআন সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিতর্কে লিপ্ত হবে। এ ধরণের ঝগড়াটে লোকদেরকে হাদিস দ্বারা রুখে দাঁড়িও। কেননা যারা হাদিসের চর্চা করে, তারাই কুরআনে অধিক পারদর্শী।
"হাদিস যদি না থাকতো তবে আমি কিয়াসের সাহায্য নিতাম।"
যিনি অন্যান্য মাযহাবের বিপরীত এবং কিয়াসের বিরুদ্ধে হওয়া সত্ত্বেও নামাযে অট্টহাসি করলে অযু ভেঙ্গে যাবে বলে রায় দেন শুধু এ জন্য যে, হাদিসে এরূপ বিধান বর্জিত হয়েছে, যে ইমামের অনুসারীরা তাদের অনুসৃত কোনো নীতি বা বিধির সপক্ষে অন্যান্য মাযহাবের তুলনায় বিশুদ্ধতর হাদিস না থাকলেও অন্তত সমমানের শুদ্ধ ও সহীহ হাদিস যেনো থাকে, সেজন্য সর্বাত্মক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালাতেন এবং সর্বোপরি যে ইমাম একটি দুর্বল হাদিস থাকতেও কিয়াসের আশ্রয় নেয়ার পক্ষপাতি নন, বরং দুর্বল হাদিসটিকেই অগ্রগণ্য মনে করেন, সেই ইমামের বিরুদ্ধে হাদিস অমান্য করার অপবাদ রটানো এক নিদারুণ অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। [তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৫৮]
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী (Copy Write)
প্রশ্ন : রসূল সা.-এর পবিত্র জীবন বৃত্তান্ত ও মহৎ চরিত্রের যে বিস্তৃত বিবরণ হাদিসের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ করতে পারেনা। আর এই সুবিশাল হাদিস ভাণ্ডার থেকে উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে তা বাদ দেয়া বা পাইকারিভাবে অস্বীকার করাও কোনো মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একটি মহলের বক্তব্য হলো, আমরা শুধু সহীহ বিশুদ্ধ হাদিসগুলোই মানি। সহীহ হাদিসের মাপকাঠি তাদের কাছে এই যে, তা যেনো কুরআনের পরিপন্থি ও সাধারণ বিবেকবুদ্ধির বিরোধী না হয়। তারা আরো বলেন, রসূল সা. এক দিক দিয়ে আল্লাহর প্রেরিত রসূল ছিলেন, আবার আর এক হিসেবে তিনি জাতির নেতা ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি ছিলেন। আল্লাহর রসূল হিসেবে তাঁর যে মহৎ চরিত্র ও আদর্শ কার্যধারা আবশ্যিকভাবে চিরদিনের জন্য অনুকরণীয়, তা কুরআনে সংরক্ষিত হয়েছে। সুন্নত বলতে যদি কিছু থেকেই থাকে তবে তা কুরআনে সন্নিবেশিত রসূলের এই আদর্শ কার্যধারা ও চরিত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এ ছাড়া তাঁর আর যেসব কথা ও কাজের বিবরণ পাওয়া যায়, তা সমাজ নেতা ও সমসাময়িক রাষ্ট্রনায়কের কথা ও কাজের চেয়ে বেশি কোনো গুরুত্ব রাখেনা। সমাজ নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর আদেশ নিষেধ শুধুমাত্র তাঁর জীবদ্দশায় যারা তাঁর অনুসারী তথা সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন তাঁদের জন্যই অবশ্য পালণীয়। পরবর্তীকালের মুসলমানদের জন্য তাঁর নির্দেশাবলী ও সিদ্ধান্তসমূহ নিছক ইসলামের দৃষ্টান্তস্বরূপ। তার হুবুগু আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য নয়। মূলত যে আনুগত্য ইসলামের দৃষ্টিতে কাংখিত, তা হচ্ছে কুরআনী বিধান অনুসারে প্রতিষ্ঠিত সমসাময়িক সরকার ও প্রশাসকমণ্ডলীর আনুগত্য। এসব শাসক ও প্রশাসকের এখতিয়ার রয়েছে যে, ইচ্ছে হলে হুবুহু রসূল সা.-এর নির্দেশ নিজেরাও মেনে চলবেন এবং দেশবাসীকেও মানতে বাধ্য করবেন, নতুবা তাতে রদবদল করে নতুন নির্দেশমালা প্রণয়ন করবেন।
রসূল সা.-এর কথা ও কাজের যে অংশের বিবরণ কুরআনে নেই, সে অংশটি শুধুমাত্র রসূল সা.-এর আমলেই অনুকরণযোগ্য, তার পরে নয়। এ বক্তব্যের সপক্ষে এই মহলটি বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকে। যেমন, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূল সা, স্বয়ং নিজের মানবীয় দিক ও নবীসুলভ দিককে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে বলেছিলেন যে, একজন মানুষ হিসেবে তিনি যা কিছু বলেন বা করেন, তা অনুসরণ করা জরুরি নয়। খোলাফায়ে রাশেদীনও বহু ব্যাপারে রসূল সা.-এর কার্যধারার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। বিশেষত হযরত ওমর প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটি সিদ্ধান্ত এমন কার্যকর করেন, যা রসূল সা. করেননি। শোনা যায়, ইমাম আবু হানিফাও ফেকাহ শাস্ত্র রচনায় হাদিসের সাহায্য নেননি। তাঁকে সহীহ হাদিস অবহিত করলেও তিনি হয় রহিত, নচেৎ অচল বলে অগ্রাহ্য করতেন এবং বলতেন, এসব নির্দেশ রসূল সা.-এর আমলে আরব জাতির জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। এগুলো হুবুহু কার্যকরী করা অন্যদের জন্য জরুরি নয়। শাহ ওয়ালী উল্লাহও এরূপ নীতি অনুসরণ করতেন বলে জানা যায়। এ মহলটি কুরআনী চিন্তাধারার ধারক বাহক বলে পরিচিত এবং তাদের মতামত আমি সংক্ষেপে আপনাকে অবহিত করলাম। আমার জিজ্ঞাসা এই যে, এই মতামত ও চিন্তাধারা হাদিস অমান্য করার সমর্থক কিনা? রসূলের নির্দেশাবলীকে শুধুমাত্র রসূলের জীবনকালেই অনুকরণীয় মনে করা এবং উল্লেখিত প্রাচীন মুসলিম মনীষীগণও এরূপ মনে করতেন বলে বিশ্বাস করা সঠিক কিনা?
জবাব : আপনি স্বীয় চিঠিতে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, সেগুলো নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত আলোচনা করা সংক্ষিপ্ত চিঠির আকারে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সুদীর্ঘ নিবদ্ধ অথবা সুপরিসর গ্রন্থ রচনা। আল্লাহর শোকর যে, বিশিষ্ট আলেমগণ বিস্তৃত নিবদ্ধ ও বইপুস্তক লিখে প্রয়োজন অনেকাংশে পূর্ণ করে দিয়েছেন। তাই আমি শুধু আপনার চিঠির দাবি অনুসারে এ সংক্রান্ত কিছু নীতি বক্তব্য পেশ করবো। সর্বপ্রথম কথা এই যে, যারা মনে করেন, রসূল সা. স্বীয় কথা থাকলে তার অনুসরণ করা কেবল তাঁর জীবদ্দশায় সাহাবাদের জন্যই বাধ্যতামূলক। এর অর্থ দাঁড়ায় তাদের মতে হাদিস স্বীকার করা আর অস্বীকার করা একই কথা। তারা নিজেদের মনগড়া মাপকাঠিতে যাচাই করে যদি কোনো হাদিসকে সহীহ এবং কুরআন ও বিবেকবুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেনও, তবে তার বাস্তব ফল এর চেয়ে বেশি কিছু হবেনা যে, তাঁরা ঐ হাদিসকে কেবল বিশুদ্ধ মেনে নিয়েই ক্ষান্ত থাকবেন। তারা বড়জোর এই বলে একটি বাস্তবতার স্বীকৃতি দেবেন যে, 'দি ক্যাপিটাল' কার্লমার্কসের লেখা বই, বা ' আরমাগানে হিজায' ইকবালের একটি কাব্য গ্রন্থ বলে কেউ একটি বাস্তবতার স্বীকৃতি দিলো। এরপর প্রশ্ন ওঠে যে, একটা জিনিসকে সত্য ও সঠিক বলে মেনে নেয়ার পর তার বাস্তব অনুসরণ করা হবে কিনা, এ প্রশ্ন উভয় ক্ষেত্রেই অবান্তর। বড়জোর তারা ততোদূরও যেতে পারেন যে, 'রাষ্ট্রনায়ক' বা 'জাতির নেতা' যদি হাদিসটিকে কার্যোপযোগী মনে করে তার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তাহলে হাদিসটি অনুসারে তারা কাজও করতে ইচ্ছুক হবেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও হাদিসের আনুগত্য এ জন্য করা হবেনা যে, ওটা রসূলের কথা বা কাজের বাহন। বরং 'রাষ্ট্রনায়ক' তার মঞ্জুরি দিয়েছেন ও আমলযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন বলেই তার আনুগত্য করা হবে। রাষ্ট্রনায়ক যদি হাদিসকে না-মঞ্জুর কিংবা সংশোধনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তাহলে তারা বড়জোর এতোটুকু করবেন যে, সহীহ হাদিসটিতেও একটা ঐতিহাসিক কীর্তি হিসেবে মেনে নিয়ে অন্যান্য ঐতিহাসিক কীর্তির ন্যায় নির্দিষ্ট সংরক্ষণাগারে রেখে দেবেন। কেননা ইতিহাস চাই আলেকজান্ডার কিংবা নেপোলিয়নের হোক, চাই আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ সা.-এর হোক, তা ইতিহাসই। তার অনুসরণ করার তো কোনো বাধ্যবাধকতা থাকেনা।
আমার মতে, এই মহান তত্ত্বের প্রবক্তাদের হাদিসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করার জন্য তাত্ত্বিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক মাপকাঠি সংগ্রহ করার এতো ঝামেলা পোহানোর কোনো প্রয়োজন ছিলনা। তারা বরঞ্চ একটা কথার উপরই অনড় হয়ে থাকলে পারতেন। সে কথাটি হলো, তাদের কথিত 'কুরআনি সরকার' যে হাদিসকে স্বীকৃতি দেবে, সেটাই চলবে। আর যে হাদিসকে সেই সরকার সমকালীন পরিস্থিতি ও বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করবে, সে হাদিস অচল মুদ্রার মতো টাকশালের বাইরে নিক্ষিপ্তি হবে। তবে যদি মতলবখানা এই হয়ে থাকে যে, হাদিস অমান্য করার গুরুতর দায় এড়ানো এবং মুসলিম গণরোধ থেকে বাঁচার জন্য তারা মুখে হাদিসের স্বীকৃতি দান এবং কাজে তা অস্বীকার করার ফন্দি এঁটে থাকেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
রসূল সা.-এর আদেশ ও নিষেধ, তাঁর ফরমান ও সিদ্ধান্ত এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে দেয়া তাঁর নির্দেশাবলী মেনে চলার বাধ্যবাধকতা শুধুমাত্র রসূল সা.-এর জীবদ্দশা পর্যন্ত সীমিত করার জন্য এ মহলটি রসূলের রিসালাত ও শাসকসূলভ মর্যাদার মধ্যে বিভেদ রেখা টানার পক্ষে যে বক্তব্য দিয়েছে, সেটাও একটা নিরর্থক ভাওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়। এ কথা তো অবিসংবাদিতভাবে সত্য যে, রসূল সা. মুসলমানদের শাসক এবং রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন, বিচারকও ছিলেন, সেনাপতিও ছিলেন এবং আরো বহু দিক দিয়ে তিনি মুসলমানদের নেতা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন। কিন্তু নবী ব্যক্তিত্বের এইসব দিকগুলো আসলে তার রসূলসূলভ পদমর্যাদারই বিভিন্ন দিক ও বিভাগ। এগুলোর একটিকে অপরটি থেকে আলাদা করা এবং একটিকে চিরস্থায়ী ও অপরটিকে অস্থায়ী আখ্যায়িত করার চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বাতলি ও অযৌক্তিক। এসব রকমারি মর্যাদা ও ভূমিকার মধ্যে দিয়েই রিসালাতের দায়িত্ব ও রসূলসূলভ তৎপরতার বিকাশ ও স্ফূরণ ঘটেছে। প্রতিটি ভূমিকায় রিসালাতের মাহাত্ম্য প্রতিফলিত এবং নবুওয়াতের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে। এগুলোর কোনটিতে নবুওয়ত ও রিসালাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে নবুওয়াত ও রিসালাত কাকে বলে, সেটাই বুঝা মুশকিল হয়ে পড়বে। এসকল ভূমিকায় রসূল সা. যেসব উল্লেখযোগ্য কর্ম সম্পাদন করেছেন, তার সবই প্রকৃতপক্ষে রিসালাতের দায়িত্ব পালনেরই বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় বিশেষ। এ সমস্ত তৎপরতা ও ভূমিকাকে কুরআন ও হাদিস উভয়টিতেই এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একটি অপরটির সাথে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ও অবিচ্ছেদ্য, তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। সেখানে রিসালাত ও রাষ্ট্রনায়কত্বের মাঝে কোনো বিভক্তি রেখা যেমন টানা হয়নি, তেমনি এমন তত্ত্বও উপস্থাপন করা হয়নি যে, মুহাম্মদ সা.-এর যেসব কথা ও কাজ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে কেবল সেগুলোই তাঁর সুন্নত ও অনুকরণীয় আদর্শ এবং কেবলমাত্র সেগুলোরই আনুগত্য করা চিরস্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক। কুরআনের বাইরে যদি রসূল সা.-এর কোনো কথা ও কাজের বিবরণ থেকে থাকে, তবে তাকে তাঁর সুন্নত ও আদর্শ বলা যাবেনা, বরং সেটা কেবল একজন নেতা ও শাসকের কথা ও কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তা তার শাসনামল অতিক্রান্ত হওয়ার পর আর অনুকরণযোগ্য থাকবেনা। এখানে এটাও লক্ষণীয় যে, শুধু কুরআনকেও যদি মানা হয়, তাহলে এতেও রসূল সা.-এর অনুকরণীয় জীবনাদর্শের এমন বহু দিক আলোচিত হয়েছে, যা তাঁর শাসকসূলভ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বলা যায়। এখন যদি রসূল সা.-এর শাসকসূলভ পদমর্যাদার কর্তব্য ও অধিকারকে রসূলসূলভ পদমর্যাদা থেকে আলাদা করে পূর্বোক্তগুলোকে সাময়িক ও অস্থায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে একথা না মেনে উপায় থাকেনা যে, নবী জীবনের নেতৃত্ব- কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা সংক্রান্ত যেসব শিক্ষা খোদ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, তাও মেনে চলার কোনো চিরস্থায়ী বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ এ ধারণা একেবারেই বাতিল, অন্যায় এবং স্বয়ং কুরআনেই সুস্পষ্ট ঘোষণার পরিপন্থি। যারা এই বিভেদ নীতির প্রবক্তা, এটা তাদেরও সেই চিন্তাধারার বিরোধী, যার আওতায় তারা অনুগ্রহ করে কুরআন বর্ণিত নবী জীবনকে আদর্শকে 'সুন্নতে রসূল' বলে মানেন এবং নিজেরাও তা মেনে চলতে চান।
এবার যেসব যুক্তি প্রমাণের আলোকে তারা রসূল সা.-এর রসূলসূলভ ও শাসকসূলভ ভূমিকায় পার্থক্য করেন, সেই যুক্তি প্রমাণগুলো কতদূর ধোপে টেকে, তা খতিয়ে দেখা যাক্ তাঁরা একটি যুক্তি দেখান এই যে, হাদিসে রসূল সা. স্বয়ং তার মানবসূলভ ও নবীসূলভ মর্যাদায় পার্থক্যের কথা বলে কিছু কিছু ব্যাপারে তাঁর আনুগত্য থেকে আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন ও স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছেন। আমি জেনে আনন্দিত হলাম যে, তারা এ সংক্রান্ত দু'একটা হাদিসকে অন্তত সহীহ মেনে নিয়ে তা দ্বারা ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি বুঝতে অক্ষম, এসব হাদিস দ্বারা রসূল সা.-এর রিসালাত ও রাষ্ট্রনায়কত্বের মাঝে বিভাজন রেখা টেনে একটিকে স্থায়ী ও অপরটিকে সাময়িক আখ্যায়িত করার তত্ত্বটি কিভাবে সঠিক প্রমাণিত হয়। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, রসূল সা.-এর মানবীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং পথপ্রদর্শক সূলভ ও শাসকসূলভ দায়িত্ব পালনকালে ঘোষিত নির্দেশাবলী ও উক্তিসমূহ কি একই ধরণের? একথা সত্য যে, রসূল সা. দ্বারা কখনো কখনো কিছু একান্ত মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও ব্যতিক্রমধর্মী স্বভাবসূলভ কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে, যার আনুগত্য করা আমাদের জন্য শরিয়ত অনুযায়ী বাধ্যতামূলক নয় কিন্তু এই ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনাবলীর আলোকে এরূপ সাধারণ মূলনীতি উদ্ভাবন করা কি কোনো মুসলমানের পক্ষে সম্ভভ যে, রসূল সা. মুসলমানদের নেতা, পথপ্রদর্শক, শিক্ষাগুরু ও শাসক হিসেবে সমগ্র জীবনব্যাপী যে অবদান ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তার কোনো কিছুই আর আমাদের জন্য অবশ্য পালনীয় নয়? অথচ তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ শুধু সাহাবায়ে কিরামকে নয় বরং অনাগত কালের সকল মুসলমানকেই দেয়া হয়েছে।১
________________________________
১. এ ধরণের নির্দেশ সম্বলিত হাদিস অনেক রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, "তোমরা আমার মৃত্যুর পর অমুক অমুক ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে অমুক অমুক কর্মপন্থা অবলম্বনা করবে।" যেসব হাদিস গ্রন্থ থেকে রসূলের নবীসূলভ মর্যাদা ও মানবসূলভ মর্যাদা সংক্রান্ত হাদিসগুলোর উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে, এসব হাদিস সেইসব গ্রন্থেই রয়েছে। এসব হাদিসের 'গুরুত্ব ও উপকারিতা' সম্পর্কে হাদিস অমান্যকারী মহলের অভিমত কি, তা অবশ্য জানা যায়নি।
রসূল সা.-এর নির্দেশাবলীকে অস্থায়ী ও সাময়িক প্রমাণ করার জন্য আরো একটা যুক্তি দেয়া হয়েছে এই যে, খোলাফায়ে রাশেদীন বহু ক্ষেত্রে রসূল সা.-এর আদেশের পরিপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে হযরত ওমরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও আমাকে দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে, এ অভিযোগ আরোপ করার সময়ও ঘটনাবলীর একপাশে ও বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরে একটা ব্যতিক্রমী বিষয়কে সাধারণ নিয়ম হিসেবে বড় করে দেখোনো হয়েছে। কতিপয় অভিজ্ঞ আলেম এ ধরণের ঘটনাবলীকে একত্র করে ও সেগুলোর বিশদ বিবরণ দিয়ে এ অভিযোগের রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছেন। তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, খোলাফায়ে রাশেদীন রসূল সা.-এর সুন্নত থেকে চুল পরিমাণও বিচ্যুত হননি। যে বিষয়গুলোকে হযরত ওমরের নতুন উদ্যোগ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে হয় কুরআন ও হাদিসে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিলনা, নচেত থাকলেও তাতে এতো প্রশস্ততা ছিলো যে, তার বাস্তবায়নে একাধিক কর্মপন্থা অবলম্বনের অবকাশ ছিলো।
এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ও বিশ্লেষণ আমি দিতে চাইনা। তার পরিবর্তে আমি আশা করবো যে, আপনি তথাকথিত কুরআনি চিন্তাধারার প্রবক্তাদের কাছেই জিজ্ঞেস করবেন, যেসব গ্রন্থে তারা খোলাফায়ে রাশেদীনের এইসব কল্পিত সুন্নত বিরোধী তৎপরতা খুঁজে হিমসিম খাচ্ছেন, সেখানে কি তারা এমন তথ্যও দেখতে পাননি যে, এই খোলাফায়ে রাশেদীনই খেলাফতের বাইয়াত তথা অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় এই বলে অঙ্গীকার করতেন : সব সময় আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নত পদক্ষেপ নেবো? শুধু তাই নয়, খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের প্রত্যেকে প্রকাশ্য জনসমাবেশে মুসলমানদেরকে বলতেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমরা কেবল ততোক্ষণ আমার কথামত চলবে যতোক্ষণ আমি আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করবো, তখন আর আমার কথামত চলতে তোমরা বাধ্য থাকবেনা।"
এসব খলিফার সামনে যখনই কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিতো। তারা প্রথমে আল্লাহর কিতাবের এবং তার পরে নিজেদের জানামতে রসূলের হাদিসের শরণাপন্ন হতেন। নিজের জ্ঞানে না কুলালে মজলিসে শূরার সদস্যদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন যে, আপনাদের কারো কাছে রসূল সা.-এর এমন কোনো উক্তি জানা আছে কিনা, যার আলোকে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। সেখানেও যদি প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা না পাওয়া যেতো, তাহলে সর্বস্তরের মুসলিম জনগণের মধ্যে ঘোষণা করে দেয়া হতো যে, অমুক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। এ সম্পর্কে রসূল সা.-এর কোনো ফরমান কারে জানা থাকলে সে যেনো তা অবিলম্বে জানায়। এভাবে কারো কাছে রসূল সা.-এর কোনো ফরমান পাওয়া গেলে খলিফা তৎক্ষণাৎ বলে উঠতেন :
------------------------------------------------------
"আল্লাহর শোকর, তিনি আমাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি রেখেছেন, যিনি ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণে তৎপর।"
সেই সাথে সত্যনিষ্ঠ খলিফা নিজের অজ্ঞতার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে বলতেন :
-------------------------------------
"ব্যবসায়ের ব্যস্ততা আমাকে অজ্ঞতায় নিমজ্জিত রেখেছে।"১
এমনকি ক্ষমতাসীন খলিফা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন এবং তারপর রসূল সা.-এর কোনো দৃষ্টান্ত অবগত হতেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে আল্লাহর শোকর আদায় করতেন যে, অজ্ঞতাবশত রসূল সা.-এর একটি নির্দেশ লংঘন থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন। প্রাদেশিক গভর্ণর, বিচারক ও শিক্ষকগণকে এই মর্মে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে দায়িত্ব নিয়োগ করা হতো যে, প্রথমে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে করণীয় খুঁজে নেবে। সেখানে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনার সন্ধান না পেলে বিবেকবুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে পাওয়া মূলনীতি ও চেতনার আলোকে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা উদ্ভাবন (এক কথায় 'ইজতিহাদ') করবে। এ ধরণের বর্ণনা হাদিসগ্রন্থ, সীরাতগ্রন্থ ও ইসলামি ইতিহাস গ্রন্থসমূহে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এবং একই গ্রন্থে বারংবার রয়েছে। এগুলোকে উপেক্ষা করে কেউ যদি কেবল নিজের মতলব সিদ্ধির সহায়ক ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোকেই খুঁজে বেড়ায় তবে তার তুলনা এমন ব্যক্তির সাথেই করা যায়, যে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে রক্ষিত মাইলফলক দেখতে পায়না, অথচ অন্ধকার কক্ষে কোনো ক্ষুদ্র কণিকাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায়। সত্যানুসন্ধানীদের রীতি এটা নয় যে, তারা প্রথমে নিজেদের ইচ্ছেমত একটা মতবাদ বানিয়ে নেবে, অতপর তার সপক্ষে কোথাও একটা তিল পাওয়া গেলেও তাকে তাল বানিয়ে দেখবে আর বিপক্ষে কোথাও পাহাড় সমান প্রমাণ পাওয়া গেলেও তার অস্তিত্বই অস্বীকার করবে। যারা বড় গলায় দাবি করেন, কুরআনের দলিল ছাড়া আমরা মুখে গ্রাস তোলারও সাহস করিনা। তাদের আপন দাবির কিছুটা তো সম্মান রাখা উচিত।
যাহোক, যে ব্যক্তি বাস্তব ঘটনাকে নিজের মর্জি মোতাবেক সাজানোর রোগে আক্রান্ত নয়, সে খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন বৃত্তান্ত পড়ে কখনো এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনা যে, এসব খলিফা নিজেদেরকে রসূলের প্রতিষ্ঠিত আদর্শ ও তথা সুন্নাহ অনুসরণে বাধ্য মনে করতেননা, বা তার বিরুদ্ধে চলার এখতিয়ার রাখেন বলে মনে করতেন। এ অভিযোগটা
____________________
১. এটি হযরত ওমরের উক্তি।
বিশেষভাবে হযরত ওমরের বিরুদ্ধে আরোপ করা হয় এবং তাঁর চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটা সিদ্ধান্তকে এর প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়। অথচ হযরত ওমরের শাসনামলে প্রায় দশ বছর ছিলো এবং এই মেয়াদকাল তিনি শত শত কোনো হাজার হাজার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বলবৎ করেছেন বললে অত্যুক্তি হবেনা। এর মধ্যে থেকে মাত্র চল্লিশ বা পঞ্চাশটা সিদ্ধান্ত যদি এমন পাওয়া যায়, যা আপাত দৃষ্টিতে রসূলের সুন্নাহের পরিপন্থি বলে মনে হয়। তাহলে প্রথমত এটা এই অভিযোগের দুর্বলতাই প্রমাণ করে। উপরন্তু যখন দেখা যায়, এ কয়টা উদাহরণ দ্বারাও বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য অস্বাভাবিক রকমের ঘুরপ্যাচের আশ্রয় নেয়া হয়েছে এবং জেনেশুনে তার সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে বা ঘটনাকে বিকৃত করে সুন্নাহর আনুগত্যের বিরুদ্ধাচরণ বানিয়ে দেখানো হয়েছে, তখন তথাকথিত এই সব 'কুরআনী চিন্তাধারা'র প্রবক্তাদের সততার প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার জন্মে। আমি এখানে নমুনাস্বরূপ মাত্র একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি। হযরত ওমর সম্পর্কে এই মহলটি বলে থাকে, তিনি তওয়াফের সময় ঘাড় দুলিয়ে চলা জরুরি মনে করতেননা। কেননা রসূল সা. তো শুধুমাত্র প্রতাপ ও বিক্রম প্রদর্শন ও কাফেরদেরকে শংকিত করার উদ্দেশ্যেই এ নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন। ইসলামে বিজয়ী হয়ে যাওয়ার পর তার আর দরকার নেই।
এখন দেখুন, সহীহ হাদিসে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সেটা এই যে, হযরত ওমর 'রামাল' অর্থাৎ ঘাড় দোলানো পরিত্যাগ করার ইচ্ছে করেছিলেন সত্য। কেননা বাহ্যত তার প্রয়োজন অবশিষ্ট ছিলনা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে ভিন্ন চিন্তার উদয় হলো এবং তিনি বললেন :
-----------------------------------------------------
"রসূল সা. যে কাজ করেছেন, তা ত্যাগ করা আমরা পছন্দ করিনা।"
বুখারির হজ্জ সংক্রান্ত অধ্যায়ে এ ঘটনার বিস্তরিত বিবরণ রয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ সম্পর্কে হাদিস অস্বীকারকারী মহল অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারণা চালিয়ে থাকে যে, তিনিও নাকি হাদিস মানতেন না এবং তাঁর গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা থেকে তারা হাদিসের অগ্রাহ্যতার পক্ষে যুক্তিপ্রমাণ যোগাড় করার চেষ্টা করতে অভ্যস্ত। অথচ সেই শাহ ওয়ালিউল্লাহর হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাতে এই ঘটনা উদ্ধৃত করার পর তিনি লেখেন : "হযরত ওমর রামাল ত্যাগ করতে চেয়োছিলেন এই যুক্তির ভিত্তিতে যে, ওটা যে কারণে প্রবর্তিত হয়েছিল তা আর অবশিষ্ট ছিলনা। কিন্তু ---------------------------------- পরক্ষণেই ওমর ভয় পেয়ে গেলেন এবং ভাবলেন, এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে, যা তাঁর জানা নেই।"
ভাবতে অবাক লাগে, যে ওমর রা. সুন্নতের ব্যাপারে এতো সতর্ক ও সচেতন ছিলেন যে, দৌড়ানোর সময় বিশেষ ধরণের ঘাড় দোলানোকে পর্যন্ত বদলাতে সাহস পাননি এবং শংকিত ছিলেন যে, খোদা না করুন, এতে রসূল সা.-এর বিরুদ্ধাচারণের দায়ে দোষী হয়ে যেতে হয় কিনা, সেই ওমর রা.-এর উপর সুন্নত পরিত্যাগ এবং সুন্নতের রদবদল বা রহিতকরণের অভিযোগ আরোপ করা হচ্ছে!১
হযরত ওমর রা. ও অন্যান্য খোলাফায়ে রাশেদীনের পর ইমাম আবু হানিফার বিরুদ্ধে সুন্নাহ বর্জন ও হাদিস অগ্রাহ্য করার যে দোষারোপ করা হয়, তার অবস্থাও তদ্রুপ। সত্য ও বাস্তবতার সাতে তার দূরতম সম্পর্ক নেই। আলেম সমাজ এ অভিযোগের বিশদ জবাব দিয়ে তা খণ্ডন করেছেন। আমি এ ব্যাপারে শুধু এতোটুকু কথাই বলবো, ইমাম আবু হানিফা ফিকাহ শাস্ত্রের সংকলন ও প্রণয়নে যে অবদান রেখে গেছেন এবং হাদিস সম্পর্কে তাঁর যে অবস্থান ছিলো, তা ইতিহাসের কোনো হারানো অধ্যায় নয় যে, ইতিহাস ও কাব্য গ্রন্থে নতুন করে তার সন্ধান চালানোর চেষ্টা করতে হবে। উপরন্তু কোনো ব্যক্তির মতামত জানার এটা কোনো সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত পন্থা নয় যে, সেই ব্যক্তি নিজে এবং তাঁর শিষ্য ও ভক্তরা তাঁর মতামতকে যেভাবে তুলে ধরেন, তা উপেক্ষা করে যারা তাঁর বিরোধিতার মনোভাব বা তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে এবং সঠিকভাবে তাঁর মতামত জানেওনা, তাদের কাছ থেকে তার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এ কথা সত্য, ইমাম সাহেবের ইজতিহাদী কর্মে হাদিসের দুর্বলতা ও বিশুদ্ধতা যাঁচাই এবং হাদিসের স্বল্পতা ও কিয়াসের আধিক্য সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বিতর্ক আগেও ছিলো, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু তাঁর হাদিস অস্বীকারের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেনা, কিংবা এমন অপবাদও তাঁর উপর আরোপ করতে পারেনা যে, সহীহ হাদিসকেও তিনি এই বলে প্রত্যাখ্যান করতেন যে, এর প্রয়োগের সময় বাসি হয়ে গেছে। যে ইমামের ঘোষণা ছিলো : "যখন কোনো ব্যাপারে সহীহ হাদিস পাওয়া যাবে তখন সেটাই হবে আমার নীতি" এবং যিনি বলতেন যে :
------------------------------------
"হাদিস যদি না থাকতো তবে আমরা কেউ কুরআন বুঝতে পারতাম না।"
এবং "-----------------------------------"
________________
১. এটা হযরত ওমরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের কারসাজিও হতে পারে। কেননা তিনি হাদিস অমান্য করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে আগাম হুশিয়ারি উচ্চারণ করে গেছেন। সুনানে দারামীতে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন : কিছু লোক আবির্ভূত হবে, যারা কুরআন সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিতর্কে লিপ্ত হবে। এ ধরণের ঝগড়াটে লোকদেরকে হাদিস দ্বারা রুখে দাঁড়িও। কেননা যারা হাদিসের চর্চা করে, তারাই কুরআনে অধিক পারদর্শী।
"হাদিস যদি না থাকতো তবে আমি কিয়াসের সাহায্য নিতাম।"
যিনি অন্যান্য মাযহাবের বিপরীত এবং কিয়াসের বিরুদ্ধে হওয়া সত্ত্বেও নামাযে অট্টহাসি করলে অযু ভেঙ্গে যাবে বলে রায় দেন শুধু এ জন্য যে, হাদিসে এরূপ বিধান বর্জিত হয়েছে, যে ইমামের অনুসারীরা তাদের অনুসৃত কোনো নীতি বা বিধির সপক্ষে অন্যান্য মাযহাবের তুলনায় বিশুদ্ধতর হাদিস না থাকলেও অন্তত সমমানের শুদ্ধ ও সহীহ হাদিস যেনো থাকে, সেজন্য সর্বাত্মক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালাতেন এবং সর্বোপরি যে ইমাম একটি দুর্বল হাদিস থাকতেও কিয়াসের আশ্রয় নেয়ার পক্ষপাতি নন, বরং দুর্বল হাদিসটিকেই অগ্রগণ্য মনে করেন, সেই ইমামের বিরুদ্ধে হাদিস অমান্য করার অপবাদ রটানো এক নিদারুণ অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। [তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৫৮]
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী (Copy Write)