ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে বিভিন্ন দিবস উদযাপন
ইসলামী শরীয়তে কিছু নির্দিষ্ট বিশেষ দিবস ও রজনী রয়েছে। নির্দিষ্ট এ সময়গুলোর বাইরে আরও কোন দিবস তৈরী করা বা উদযাপন করার ব্যাপারে ইসলাম আমাদের উৎসাহিত করে না। কারণ, আমাদের ইতিহাস সাড়ে ১৪শ’ বছরের ইতিহাস। এখন ১৪৩৬ হিজরী চলমান। এর অর্থ হল আজ থেকে ১৪৩৬ বছর আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করেছেন। হিজরতের পূর্বে মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করেছেন। নবুওয়াতের পর হিজরতের আগের ১৩ বছরসহ আমাদের শরীয়তের ইতিহাস সাড়ে ১৪শ’ বছরের। এ দীর্ঘ সময়ে বহু এমন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বিশেষ দিবসের দাবী রাখে। যেসব ঘটনা কেন্দ্র করে আমাদের দেশে দিবস উদযাপিত হয় এর চেয়ে বহুগুণ তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্যাদাবান ঘটনা ইসলামের এ দীর্ঘ ইতিহাসে এত পরিমাণ বিদ্যমান রয়েছে যে, যার সবগুলোকে উদযাপন করা হলে বছরের ৩৬৫ দিনই দিবস উদযাপিত হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় কমপক্ষে একশ’টি ঘটনা অবশ্যই এমন পাওয়া যাবে যার প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন দিবস হতে পারে যেমন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিবস, দুধমার নিকট যাওয়ার দিবস, বক্ষবিদারণ দিবস, মাতৃবিয়োগ দিবস, কাবা সংস্কার দিবস, হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা দিবস, সিরিয়া গমন দিবস ও প্রত্যাবর্তন দিবস, হজরে আসওয়াদ স্থাপন দিবস, নবুওয়াতপ্রাপ্তি দিবস, আবু কুবাইসে ভাষণ প্রদান, মক্কার বিশিষ্ট নাগরিকদের বাড়িতে আমন্ত্রণ, ওকাজ মেলায় বক্তৃতা, তায়েফ গমন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া, হযরত খাদিজা রাযি. এর মৃত্যু, চাচা আবু তালিবের মৃত্যু ইত্যাদি দিবস। হিজরতের দিবস, বদর, উহুদ, খন্দক যুদ্ধের দিবস, নামায, রোযা, জিহাদ ইত্যাদি ফরজ হওয়ার দিবস- এভাবে রাসূলের জীবদ্দশায়ই একশ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একশ দিবস হয়ে যাবে। এরপর রাসূলের পর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও বহু স্মরণীয় ঘটনা রয়েছে। যেমন, ইরাক ও ইরান বিজয়, সিরিয়া বিজয়, আমর ইবনুল আস রাযি. কর্তৃক মিসর বিজয়, উকবা ইবনে নাফে রাযি. কর্তৃক আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল বিজয়, কুসাম বিন আব্বাস রাযি. কর্তৃক রাশিয়া বিজয়- এভাবে হিসেব করলে বহু বিজয় দিবস হবে শুধু সাহাবায়ে কেরামের যুগেই। এরপর উম্মাহর জীবনে কত যে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস ও শোক দিবস পাওয়া যাবে তার কোন সীমা সরহদ নেই।
অপরদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের দিবস, হযরত আবূ বকর রাযি. এর মৃত্যুদিবস, হযরত উমর রাযি. এর শাহাদাত দিবস, উসমান রাযি. ও আলী রাযি. এর শাহাদাতের দিবস, ইমাম হুসাইন রাযি. এর শাহাদাত দিবস- এভাবে আরও অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে। এ দিনগুলো কি মুসলমানের পালনীয় দিবস হতে পারে না? এভাবে হিসেব করলে সাহাবাযুগের ঘটনা কেন্দ্র করেই আরও একশ’টি দিবস উদযাপন করা যাবে।
মুসলমানদের প্রায় সাড়ে ১৩শ’ বছরের ইতিহাসের বহু ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিবস উদযাপিত হতে পারে। শুধু আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসেই একশ’টি দিবস হতে পারে। এর বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের ইতিহাস থেকে আর ৬৫টি দিবস অনায়াসেই বাছাই করা যাবে। বুঝা গেল, দিবস উদযাপন করা হলে ইসলামের সুদীর্ঘ সাড়ে ১৪শ’ বছরের ইতিহাসের আলোকে বছরের ৩৬৫ দিনই কোন না কোন দিবস উদযাপন করতে হবে।
এবার ভেবে দেখি, যদি বছরের ৩৬৫ দিনই বিশেষ দিবস উদযাপিত হয় আর এর প্রতিটিতেই আমাদের ছুটি থাকে তাহলে কী অবস্থা হবে। দিবস পালন করা হলে একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি পালন করার সুযোগ কোথায়? এর একটিও তো অন্যটির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মনে রাখতে হবে, ইসলাম একটি প্রগতিশীল ও জীবনবাদী ধর্ম। এখানে কাজ বন্ধ রেখে শুধু উৎসব-আনন্দ বা শোকতাপ-কান্নাকাটি করার কোন সুযোগ নেই। ৩৬৫ দিনই গুরুত্বপূর্ণ দিবস রয়েছে তাই বলে কি ৩৬৫ দিনই কাজ বন্ধ রাখব? ইসলামের কনসেপট হল, কোন দিবস নেই। যেদিন আপনার পিতা মারা গেলেন সেদিন কি আপনার জন্য জোহরের নামাজ মাফ? কেউ কি বলবে- থাক ওর বাবা মারা গেছে আজ নামাজ না পড়ুক। কোনদিন যদি বাংলাদেশে প্রচণ্ড ঝড় তুফানে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় তাহলে ঐ দিন কি এশার নামাজ মাফ? পরের দিন কি ফজরের আযান হবে না? ইসলামে আনন্দ উৎসবের দিনেও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটার সুযোগ রাখা হয়নি। ঈদের দিনে ফরজ নামাজগুলো পড়তে হবে না, এমন তো নয়। বরং উৎসব উপলক্ষে ঈদের আরো দুই রাকাত ওয়াজিব নামায মহানন্দে আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে। বান্দার জন্য আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না।
যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিবস পালন করেন না তাদের যুক্তি হল, ইসলামের দৃষ্টিতে যদি তা পালনীয় হত তাহলে সাহাবায়ে কেরাম তা পালন করতেন। সাহাবায়ে কেরামের চেয়ে নবীকে কে বেশি ভালোবাসে? তাঁরা রাসূলের জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, সকল সম্পত্তি দান করে পরম ধন্য ও আনন্দিত হয়েছেন, জিহাদের ময়দানে রাসূলকে তীরের আঘাত থেকে রক্ষা করতে বুক পেতে দিয়েছেন, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দেখা গেছে তাঁদের শরীরে অসংখ্য তীরের আঘাত। যে মানুষগুলো রাসূলকে এতো ভালোবাসতেন তারা কেন রাসূলের জন্মদিবসে উৎসব করেননি। রাসূল তো ৬৩ বছর দুনিয়ার জিন্দেগিতে ছিলেন, একদিনও তো বললেন না তোমরা আমার জন্মদিনে উৎসব কর, মিছিল কর। ইসলামে দিবস পালন স্বীকৃত নয় তাই সাহাবায়ে কেরাম এসব পালন করেননি।
আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন জুমার দিন। এ দিনে কি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মাফ? না, বরং এদিনে কাজ আরও বেশি। ফজরের পর থেকেই জুমার প্রস্তুতি নিতে হয়। অন্যদিনের জোহরের নামাজ প্রয়োজনে ঘরে পড়ে নেয়া যায় কিন্তু জুমার দিন মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। কোরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمُعَۃِ فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللهِ وَ ذَرُوا الْبَیْعَ ؕ
ওহে যারা ঈমান এনেছ! যখন জুমার নামাযের আযান হয় তখন আল্লাহর যিকিরের উদ্দেশ্যে দ্রুত অগ্রসর হও। ব্যবসা বাণিজ্য তথা পার্থিব কাজ-কারবার বন্ধ কর।
জুমার দিনে আযানের সঙ্গে সঙ্গেই মসজিদের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম নিদর্শন শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ.। জুমার দিনে তাঁকে দেখা যেত- তিনি গোসল করে কাপড় ধুয়ে দিতেন। তাঁদের জীবন অত্যন্ত সাদাসিধা ছিল। এক কাপড়েই জীবন কাটাতেন। যে কাপড়টি ধুয়ে দিলেন তা পরিধান করেই জুমা আদায় করতে যাবেন। জুমার ওয়াক্ত শুরু হলেই দেখা যেত- তিনি লুঙ্গি গায়ে মসজিদের দিকে ছুটছেন, ভেজা পাঞ্জাবী তার কাঁধে অথবা লাঠিতে ঝুলানো। লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন- জুমার আযানের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে ছুটে যাওয়ার প্রতি আল্লাহ তাআলা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন- فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللهِ অর্থাৎ আল্লাহর যিকিরের উদ্দেশ্যে দ্রুত অগ্রসর হও।
আমি আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে আযানের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের দিকে ছুটতে থাকি।
যে জুমার দিন আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি সেদিনও মূলত কাজ বন্ধ নেই; বরং অতিরিক্ত কাজ রয়েছে। আর শুক্রবার দিন আমাদের ছুটির দিন এটাও পুরোপুরি ঠিক বলে মনে হয় না। আসলে শুক্রবারে কাজ বন্ধ ও ছুটি বলতে জুমার নামাযের জন্য বন্ধ। আযান হলে কাজ বন্ধ থাকবে, নামাজ শেষ হয়ে গেলে সকলেই নিজ নিজ কাজে ফিরে যাবে। বলা হয়েছে-
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ
জুমার নামায আদায় হয়ে গেলে তোমরা তোমাদের কাজে যমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর। সূরা জুমা :
এজন্য আমাদের আকাবেরদের কারো কারো জীবনীতে পাওয়া যায়, তারা জুমার পর কোন কাজে বেরিয়ে পড়তেন। তারা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনের জন্য এমনটি করতেন।
বুঝা গেল, আমাদের বিশেষ দিবসে ছুটির পরিমাণ এতটুকু, কয়েক ঘণ্টামাত্র। আর এ বন্ধ বা ছুটি তো আমাদের কাজ আরও ভালোভাবে করার জন্যই, বেশি কাজের জন্য। যেমন, ১০ই মুহাররম একটি বিশেষ দিন। এদিনে অন্যান্য ইবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি বাড়তি আরেকটি ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। তা হল, রোযা রাখা। ফরজ রোযার পর সবচেয়ে ফজীলতপূর্ণ রোযা হল, মুহাররম মাসের রোযা। হাদীস শরীফে ১০ই মুহাররমের আগে বা পরে একদিন মিলিয়ে রোযা রাখার কথা এসেছে। ১০ তারিখের আগে বা পরে আরেকটি রোযা রাখার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, ইহুদীদের বিপরীত কর। তারা একদিন রোযা রাখে তোমরা দু’দিন রাখ। এখানে অন্য জাতির সাথে ইবাদতের ক্ষেত্রেও বৈপরিত্ব ধরে রাখার নীতি লক্ষণীয়। বর্তমানে মুসলমানদের মনগড়া উৎসব আয়োজনেও দেখা যায়, সংস্কৃতির নামে ভিন্নজাতির অনুকরণ।
মূল কথা হল, আমাদের মনে ইসলামের এই কনসেপ্ট তথা ধারনা ও বিশ্বাস নির্মাণ করতে হবে যে, ইসলামে কোন দিবস পালনের কথা নেই। তবে কোন রাষ্ট্র বা সমাজে যদি কোন দিবস প্রচলিত থাকে যা দেশের নাগরিকরা পালন করে তবে তা আমরা ততটুকু পালন করব যতটুকু আমাদের শরীয়ত অনুমোদন করে। আর তা-ও পালন করব আমাদের মতো করে। কোন দিবস বা বিশেষ দিনে যেমন মসজিদের আযান বন্ধ থাকে না তেমনি আমাদের দ্বীনি শিক্ষাও বন্ধ থাকবে না। আমাদের কওমি মাদরাসার ইতিহাসে এমন ঘটনা নেই। কারণ, কওমি মাদরাসা কোন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কাওমি মাদরাসাগুলো ইবাদতখানা। এসব কেবল দরসগাহ নয়, তরবিয়তগাহ্, খানকাহ্ ও ইবাদতগাহ্ও বটে। বছরের কোন একটি দিনে যেমন মসজিদে যাওয়া বন্ধ হয় না তেমনি আমাদের মাদরাসার কুরআন তিলাওয়াত ও হাদীসের পাঠও বন্ধ হবে না। কোন দেশের সংস্কৃতি ও নিয়ম-কানুন শরীয়ত পরিপন্থী না হলে পালন করতে নিষেধ নেই। তবে মুসলামান পৃথিবীর যে দেশ ও সমাজেই বসবাস করুক না কেন শরীয়তবিরোধী বিশ্বাস, কর্ম বা সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ তার জন্য বৈধ নয়। এমন কোন রীতি-ঐতিহ্য পালনও তার জন্য জায়েয নয় যা ইসলামের দৃষ্টিতে গুনাহের কাজ।
অপরদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের দিবস, হযরত আবূ বকর রাযি. এর মৃত্যুদিবস, হযরত উমর রাযি. এর শাহাদাত দিবস, উসমান রাযি. ও আলী রাযি. এর শাহাদাতের দিবস, ইমাম হুসাইন রাযি. এর শাহাদাত দিবস- এভাবে আরও অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে। এ দিনগুলো কি মুসলমানের পালনীয় দিবস হতে পারে না? এভাবে হিসেব করলে সাহাবাযুগের ঘটনা কেন্দ্র করেই আরও একশ’টি দিবস উদযাপন করা যাবে।
মুসলমানদের প্রায় সাড়ে ১৩শ’ বছরের ইতিহাসের বহু ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিবস উদযাপিত হতে পারে। শুধু আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসেই একশ’টি দিবস হতে পারে। এর বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের ইতিহাস থেকে আর ৬৫টি দিবস অনায়াসেই বাছাই করা যাবে। বুঝা গেল, দিবস উদযাপন করা হলে ইসলামের সুদীর্ঘ সাড়ে ১৪শ’ বছরের ইতিহাসের আলোকে বছরের ৩৬৫ দিনই কোন না কোন দিবস উদযাপন করতে হবে।
এবার ভেবে দেখি, যদি বছরের ৩৬৫ দিনই বিশেষ দিবস উদযাপিত হয় আর এর প্রতিটিতেই আমাদের ছুটি থাকে তাহলে কী অবস্থা হবে। দিবস পালন করা হলে একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি পালন করার সুযোগ কোথায়? এর একটিও তো অন্যটির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মনে রাখতে হবে, ইসলাম একটি প্রগতিশীল ও জীবনবাদী ধর্ম। এখানে কাজ বন্ধ রেখে শুধু উৎসব-আনন্দ বা শোকতাপ-কান্নাকাটি করার কোন সুযোগ নেই। ৩৬৫ দিনই গুরুত্বপূর্ণ দিবস রয়েছে তাই বলে কি ৩৬৫ দিনই কাজ বন্ধ রাখব? ইসলামের কনসেপট হল, কোন দিবস নেই। যেদিন আপনার পিতা মারা গেলেন সেদিন কি আপনার জন্য জোহরের নামাজ মাফ? কেউ কি বলবে- থাক ওর বাবা মারা গেছে আজ নামাজ না পড়ুক। কোনদিন যদি বাংলাদেশে প্রচণ্ড ঝড় তুফানে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় তাহলে ঐ দিন কি এশার নামাজ মাফ? পরের দিন কি ফজরের আযান হবে না? ইসলামে আনন্দ উৎসবের দিনেও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটার সুযোগ রাখা হয়নি। ঈদের দিনে ফরজ নামাজগুলো পড়তে হবে না, এমন তো নয়। বরং উৎসব উপলক্ষে ঈদের আরো দুই রাকাত ওয়াজিব নামায মহানন্দে আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে। বান্দার জন্য আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না।
যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিবস পালন করেন না তাদের যুক্তি হল, ইসলামের দৃষ্টিতে যদি তা পালনীয় হত তাহলে সাহাবায়ে কেরাম তা পালন করতেন। সাহাবায়ে কেরামের চেয়ে নবীকে কে বেশি ভালোবাসে? তাঁরা রাসূলের জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, সকল সম্পত্তি দান করে পরম ধন্য ও আনন্দিত হয়েছেন, জিহাদের ময়দানে রাসূলকে তীরের আঘাত থেকে রক্ষা করতে বুক পেতে দিয়েছেন, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দেখা গেছে তাঁদের শরীরে অসংখ্য তীরের আঘাত। যে মানুষগুলো রাসূলকে এতো ভালোবাসতেন তারা কেন রাসূলের জন্মদিবসে উৎসব করেননি। রাসূল তো ৬৩ বছর দুনিয়ার জিন্দেগিতে ছিলেন, একদিনও তো বললেন না তোমরা আমার জন্মদিনে উৎসব কর, মিছিল কর। ইসলামে দিবস পালন স্বীকৃত নয় তাই সাহাবায়ে কেরাম এসব পালন করেননি।
আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন জুমার দিন। এ দিনে কি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মাফ? না, বরং এদিনে কাজ আরও বেশি। ফজরের পর থেকেই জুমার প্রস্তুতি নিতে হয়। অন্যদিনের জোহরের নামাজ প্রয়োজনে ঘরে পড়ে নেয়া যায় কিন্তু জুমার দিন মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। কোরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمُعَۃِ فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللهِ وَ ذَرُوا الْبَیْعَ ؕ
ওহে যারা ঈমান এনেছ! যখন জুমার নামাযের আযান হয় তখন আল্লাহর যিকিরের উদ্দেশ্যে দ্রুত অগ্রসর হও। ব্যবসা বাণিজ্য তথা পার্থিব কাজ-কারবার বন্ধ কর।
জুমার দিনে আযানের সঙ্গে সঙ্গেই মসজিদের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম নিদর্শন শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ.। জুমার দিনে তাঁকে দেখা যেত- তিনি গোসল করে কাপড় ধুয়ে দিতেন। তাঁদের জীবন অত্যন্ত সাদাসিধা ছিল। এক কাপড়েই জীবন কাটাতেন। যে কাপড়টি ধুয়ে দিলেন তা পরিধান করেই জুমা আদায় করতে যাবেন। জুমার ওয়াক্ত শুরু হলেই দেখা যেত- তিনি লুঙ্গি গায়ে মসজিদের দিকে ছুটছেন, ভেজা পাঞ্জাবী তার কাঁধে অথবা লাঠিতে ঝুলানো। লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন- জুমার আযানের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে ছুটে যাওয়ার প্রতি আল্লাহ তাআলা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন- فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللهِ অর্থাৎ আল্লাহর যিকিরের উদ্দেশ্যে দ্রুত অগ্রসর হও।
আমি আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে আযানের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের দিকে ছুটতে থাকি।
যে জুমার দিন আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি সেদিনও মূলত কাজ বন্ধ নেই; বরং অতিরিক্ত কাজ রয়েছে। আর শুক্রবার দিন আমাদের ছুটির দিন এটাও পুরোপুরি ঠিক বলে মনে হয় না। আসলে শুক্রবারে কাজ বন্ধ ও ছুটি বলতে জুমার নামাযের জন্য বন্ধ। আযান হলে কাজ বন্ধ থাকবে, নামাজ শেষ হয়ে গেলে সকলেই নিজ নিজ কাজে ফিরে যাবে। বলা হয়েছে-
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانْتَشِرُوْا فِی الْاَرْضِ وَ ابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ
জুমার নামায আদায় হয়ে গেলে তোমরা তোমাদের কাজে যমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর। সূরা জুমা :
এজন্য আমাদের আকাবেরদের কারো কারো জীবনীতে পাওয়া যায়, তারা জুমার পর কোন কাজে বেরিয়ে পড়তেন। তারা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনের জন্য এমনটি করতেন।
বুঝা গেল, আমাদের বিশেষ দিবসে ছুটির পরিমাণ এতটুকু, কয়েক ঘণ্টামাত্র। আর এ বন্ধ বা ছুটি তো আমাদের কাজ আরও ভালোভাবে করার জন্যই, বেশি কাজের জন্য। যেমন, ১০ই মুহাররম একটি বিশেষ দিন। এদিনে অন্যান্য ইবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি বাড়তি আরেকটি ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। তা হল, রোযা রাখা। ফরজ রোযার পর সবচেয়ে ফজীলতপূর্ণ রোযা হল, মুহাররম মাসের রোযা। হাদীস শরীফে ১০ই মুহাররমের আগে বা পরে একদিন মিলিয়ে রোযা রাখার কথা এসেছে। ১০ তারিখের আগে বা পরে আরেকটি রোযা রাখার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, ইহুদীদের বিপরীত কর। তারা একদিন রোযা রাখে তোমরা দু’দিন রাখ। এখানে অন্য জাতির সাথে ইবাদতের ক্ষেত্রেও বৈপরিত্ব ধরে রাখার নীতি লক্ষণীয়। বর্তমানে মুসলমানদের মনগড়া উৎসব আয়োজনেও দেখা যায়, সংস্কৃতির নামে ভিন্নজাতির অনুকরণ।
মূল কথা হল, আমাদের মনে ইসলামের এই কনসেপ্ট তথা ধারনা ও বিশ্বাস নির্মাণ করতে হবে যে, ইসলামে কোন দিবস পালনের কথা নেই। তবে কোন রাষ্ট্র বা সমাজে যদি কোন দিবস প্রচলিত থাকে যা দেশের নাগরিকরা পালন করে তবে তা আমরা ততটুকু পালন করব যতটুকু আমাদের শরীয়ত অনুমোদন করে। আর তা-ও পালন করব আমাদের মতো করে। কোন দিবস বা বিশেষ দিনে যেমন মসজিদের আযান বন্ধ থাকে না তেমনি আমাদের দ্বীনি শিক্ষাও বন্ধ থাকবে না। আমাদের কওমি মাদরাসার ইতিহাসে এমন ঘটনা নেই। কারণ, কওমি মাদরাসা কোন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কাওমি মাদরাসাগুলো ইবাদতখানা। এসব কেবল দরসগাহ নয়, তরবিয়তগাহ্, খানকাহ্ ও ইবাদতগাহ্ও বটে। বছরের কোন একটি দিনে যেমন মসজিদে যাওয়া বন্ধ হয় না তেমনি আমাদের মাদরাসার কুরআন তিলাওয়াত ও হাদীসের পাঠও বন্ধ হবে না। কোন দেশের সংস্কৃতি ও নিয়ম-কানুন শরীয়ত পরিপন্থী না হলে পালন করতে নিষেধ নেই। তবে মুসলামান পৃথিবীর যে দেশ ও সমাজেই বসবাস করুক না কেন শরীয়তবিরোধী বিশ্বাস, কর্ম বা সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ তার জন্য বৈধ নয়। এমন কোন রীতি-ঐতিহ্য পালনও তার জন্য জায়েয নয় যা ইসলামের দৃষ্টিতে গুনাহের কাজ।
কপি সোর্স : মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
http://monthlyniamat.com