Islamic World ..................
প্রশ্ন : মুসলমানদের সর্বসম্মত বিশ্বাস হলো, রসূল সা.-এর উপর কুরআন ছাড়াও ওহী নাযিল হতো। সেই ওহীই আমাদের কাছে রসূলের সা. হুকুম ও বাণী হিসেবে বিদ্যমান। কিন্তু আজকাল কেউ কেউ বলছেন, কুরআন ছাড়া আর কোনো ওহী আসতোনা। তাদের সবচেয়ে বড় যুক্তি এই যে, রসূল সা.-এর প্রত্যেকটি কথাই যদি ওহীভিত্তিক হতো, তা হলে তাঁর কোনো কোনো কথায় কুরআনের সমালোচনা করা হয়েছে কেন এবং অন্যদের কথায় তিনি নিজের কোনো কোনো মত পরিবর্তন করেছেন কেন? কোনো কোনো হাদিসে তো এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। 'মাকামে সুন্নাত' (সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা নামক একখানা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। ঐ পুস্তকে কুরআন ছাড়া আর কোনো ওহী আসতো না- এই মতের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও তার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে উল্লেখিত যুক্তির পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। অধিকন্তু গ্রন্থকার এটিকে একটি অকাট্য যুক্তি হিসেবে পেশ করার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, হাদিসে কুদসী (যে হাদিসে স্বয়ং আল্লাহর উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে) এবং ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে রসূল সা.-এর কথা ও কাজ ওহী নয়। তাই ওগুলোতে রদবদল চলতে পারে। অনুগ্রহপূর্বক ব্যাখ্যা করুণ যে, ওহীকে কুরআনের মধ্যে এবং নবী জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশে সীমাবদ্ধ মনে করার এই মতবাদ কতখানি সঠিক?
'মাকামে সুন্নাত' নামক বইটির আরো কয়েকটি বিষয় গভীর বিচার বিবেচনার দাবি রাখে। জানিনা আপনি ওটা পড়ে দেখেছেন কিনা। এক জায়গায় তিনি 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা' গ্রন্থের বরাত দিয়ে লিখেছেন বুখারি ও মুসলিম শরিফে এই মর্মে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, পানির অভাব দেখা দিলে সহবাসজনিত অপবিত্রতা দুরিকরণে তায়াম্মুম গোসলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে কিনা সে ব্যাপারে হযরত ওমর রা. ও হযরত আম্মার রা.-এর মধ্যে আজীবন মতবিরোধ চলছিলো। অথচ কুরআনে দুই জায়গায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এরূপ ক্ষেত্রে তায়াম্মুম করে নাও। এ দ্বারা কি বুঝা যায় যে, উভয় সাহাবি কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন এবং তাঁদেরকে কুরআনের উক্ত বক্তব্য অবহিত করারও কেউ ছিলোনা? অথবা কুরআন সাহাবাদের নিকট চূড়ান্ত দলিল ছিলোনা? আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হযরত আম্মার তায়াম্মুমের পক্ষে এই বলে যুক্তি প্রদর্শন করতেন যে, রসূল সা.-এর অনুমতি দিয়েছেন। অথচ তাতেও হযরত ওমর রা. আশ্বস্ত হতে পারেননি। তবে পরবর্তী কালের লোকেরা আশ্বস্ত হয়ে গেছে এবং তাও হয়েছে কুরআন দ্বারা নয় বরং এই হাদিস দ্বারা। কারণ তাদের কাছেও কুরআনের চেয়ে হাদিস অগ্রগণ্য। মোটকথা, এই সর্বসম্মত হাদিসের উপর অনেক লম্বা চওড়া আপত্তি তোলা হয়েছে এবং ইচ্ছেমত উপহাস করা হয়েছে। এতে আমার মন নিদারুণভাবে ক্ষুব্ধ। প্রশ্ন হলো, এ হাদিসটি কি শুদ্ধ? এর তাৎপর্য কি?
জবাব : রিসালতের পদটির মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করা, রসূলের সুন্নাহর সাথে উম্মাতের সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সুন্নাহর আইনগত মর্যাদাকে জনসাধারণের চোখে সংশয়পূর্ণ ও গুরুত্বহীন করে তোলার দুরভিসন্ধি নিয়ে এ যাবত যে কয়টি মতবাদ রচিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি মতবাদ এই যে, রসূল সা.-এর নিকট মাত্র এক ধরনের ওহী নাযিল হয়েছে, যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরে আর কোনো ওহীর কথা স্বীকার করা ইহুদীদের কুসংস্কার, যার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। সুন্নাহর অতীব মহান ও পবিত্র ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা ছাড়াও এই মতবাদ দ্বারা আরো একটি যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সেটি হলো সুন্নাহ যেহেতু ওহীভিত্তিক নয়, তাই ওটা কেবল রসূল সা.-এর ব্যক্তিগত চিন্তা গবেষণা প্রসূত অভিমত মাত্র। এটি কোনো সর্বজন মান্য আইনের মর্যাদা রাখেনা। বরঞ্চ মুসলমানরা নিজস্ব চিন্তা গবেষণার ভিত্তিতে এর বিপরীত সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এটা যে কতদূর ভ্রান্ত মতবাদ, তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। কেননা খোদ কুরআন থেকেই প্রমাণিত যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত পঠিত ও লিখিত ওহী ছাড়াও এমন বহু ওহী শুধু মুহাম্মদ সা. নয় বরং আল্লাহর প্রত্যেক নবীর কাছেই নাযিল হতো, যার উপর নিজের আমল করা এবং গোটা উম্মতকে দিয়ে আমল করানো সকল নবীর নবুওয়াতের উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সব ওহীকে এরূপ মনে করারও অবকাশ ছিলোনা যে, তা হয়তো মৌমাছির নিকট অবচেতনভাবে বা প্রাকৃতিকভাবে প্রেরিত প্রত্যাদেশের মতো হবে। অথবা আকাশ ও পৃথিবীর নিষ্প্রাণ পদার্থের নিকট অবতীর্ণ প্রাকৃতিক ওহীর মতো হবে। তথাপি হাদিস বিরোধীদের কর্মপন্থা এই যে, যে জিনিস তাদের কাছে ভালে লাগে ও তাদের স্বার্থের অনুকূল হয়, সেটা উদ্ধারের পথে অন্তরায় হয়, তা কুরআনে যে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, এই গোষ্ঠি ভুলেও তার কথা মুখে আনেনা। কিন্তু কুরআন ছাড়া রসূল সা.-এর নিকট আর কোনো ওহী আসতোনা এই মর্মে কোনো যুক্তি প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় কিনা, তার অন্বেষণে তারা হাদিস কুরআন দুটোই চষে ফেলতে ভীষণ তৎপর। এ ধরণের কোনো প্রমাণ উদ্ধার করা তো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কুরআন ও হাদিসে এরূপ মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি ঘটনা তাদের হস্তগত হয়েছে।, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, রসূল সা.-এর কোনো কাজে ওহী দ্বারা সাবধান করা হয়েছে, অথবা রসূল সা. কারো পরামর্শে নিজের মত পরিবর্তন করেছেন। আর এইটুকু মাল-মশলা হাতে পেয়েই তা দিয়ে তারা নিজেদের মনগড়া মতবাদের সপক্ষে যুক্তিতর্কের এক বিরাট প্রাসাদ গড়ে তুলেছে।
এই যুক্তিতর্ক নিয়ে যদি সামান্যতম চিন্তাভাবনাও করা হয়, তা হলে পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, এতে যে ঘটনাগুলোকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে, তা দ্বারা কু্রআন বহির্ভুত ওহীর অস্তিত্ব অস্বীকারকারীদের বক্তব্য যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়না, তেমনি তা দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের দাবিও অসত্য প্রমাণিত হয়না। অস্বীকারকারীদের বক্তব্য হলে রসূল সা.-এর উপর কুরআন ব্যতীত আর কোনো ওহী কোনো ব্যাপারেই নাযিল হয়নি। উল্লেখিত ঘটনাবলী দ্বারা শুধু এতোটুকুই প্রমাণিত হয় যে, কিছু কিছু ব্যাপারে এমনও রয়েছে যাতে ওহী অবতীর্ণ হয়নি কিংবা যাতে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কিছুটা বিরতি ঘটেছিলো। অস্বীকারকারীদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। পক্ষান্তরে সাধারণ মুসলিম জনতার বক্তব্য ও বিশ্বাস হলো, রসূল সা.-এর কথা ও কাজ হয় অবিকল ওহীভিত্তিক, নতুবা ওহীর নির্দেশে সম্পাদিত হয়েছে। তাই তা আল্লাহর ইচ্ছে ও সন্তোষের সর্বোত্তম প্রতীক। আর যদি কোনো কাজ ওহীর নির্দেশিত পথ থেকে সামান্য পরিমাণেও সরে গিয়ে থাকে, তবে ওহীর মাধ্যমেই তৎক্ষনাৎ তা শুধরে দেয়া হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নবীদের নিষ্প্রাণ হওয়ার যে তত্ত্ব প্রমাণিত তা এটাই। কেবল গুটিকয়েক ঘটনা ও কার্যকলাপ ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ঘটনা ও কার্যকলাপ এমনি ধরনের যে, তাতে রসূল সা.-এর কর্মপদ্ধতি হয় হুবুহু ওহীভিত্তিক, নচেত তা ওহীর দাবি ও আল্লাহর ইচ্ছেকে এমন নিখুঁতভাবে ও ইপ্সিত মানে পূর্ণ করতো যে, তাতে আর ওহীর মাধ্যমে সংশোধনের প্রয়োজনই থাকতোনা। সে ক্ষেত্রে ওহীর নিরবতা বা নাযিল না হওয়াটাও মূলত সম্মতি ও অনুমোদনেরই পর্যায়ভুক্ত। অন্যথায় যে নবীর উপর ওহীর এমন কঠোর তদারকী বিরাজ করতো যে, তিনি শুধু ঠোঁট নাড়লেই ------------------ (তুমি জিভ নেড়ো না) বলে সতর্ক করে দেয়া হতো, এবং যিনি একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেই সূরা নাযিল হয়ে যেতো, সেই নবী নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে আল্লাহর সন্তুষ্টি চুল পরিমাণ লংঘন করবেন অথচ ওহী এসে তৎক্ষণাৎ তাঁকে শুধরে দেবেন না, এটা কিভাবে কল্পনা করা যেতে পারে? কাজেই গুটিকয়েক ঘটনাকে বেছে বেছে দেখালেই আমাদের এ বক্তব্য খণ্ডিত হয়না যে, মোটামুটিভাবে এবং সামগ্রিকভাবে গোটা নবী জীবন ওহীর পথনির্দেশনার উপর প্রতিষ্ঠিত। বরঞ্চ সতর্কীকরণ ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে ওহী নাযিল হওয়ার মাত্র গুটিকয় ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা আমাদের বক্তব্যকে আরো মজবুত করে।
বিরোধী পক্ষ এখানে এই বলে আপত্তি জানাতে পারে যে, রসূল সা.-এর নির্মল জীবন ও মহৎ চরিত্রের অধিকাংশ ওহীভিত্তিক বলে সাধারণ মুসলমানগণ বিশ্বাস পোষণ করে এ কথা ঠিক নয়। কেননা তাদের অনেকেই মনে করে রসূলের প্রতিটি তৎপরতাই ওহী। এ দাবির সপক্ষে তারা -------------------------------------------- (তিনি মনগড়াভাবে কোনো কথাই বলেন না। তিনি যাই বলেন তা ওহী ছাড়া আর কিছু নয়।) এই আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকে। আমি এর জবাবে বলতে চাই, আসলে এই দু'টো বক্তব্যের মধ্যে কোনো বৈপরিত্য নেই নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রসূল সা.-এর পক্ষ থেকে যে হাজারো কথা, কাজ, আদেশ ও নিষেধ জারি হয়েছে তার মধ্যে অতি নগণ্য ও বিরল সংখ্যকই এমন রয়েছে, যা ওহীভিত্তিক নয়। এগুলো সংখ্যায় এতো অল্প যে তা হিসেবে ধরার মতোই নয় এবং তাতে -------------------------------- "তিনি যাই বলেন তা ওহী ছাড়া কিছু নয়" উক্তিটি থেকে যে মূলনীতি উদ্ভাবন করা হয়েছে, (অর্থাৎ রসূলের জীবন ও কর্ম সামগ্রিকভাবে ওহীভিত্তিক) তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনা। যে বক্তব্য শতকরা ৯৯ বা তার চেয়েও বেশি অংশের ব্যাপারে সঠিক ও প্রযোজ্য, তাকে যদি মূলনীতির আকারে বর্ণনা করা হয়, তবে এই বচনভঙ্গিটি মোটেই অসত্য এ অশুদ্ধ নয়। সামগ্রিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার বেলায় অধিকাংশের বা সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থাটাই সব সময় প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। এ সত্যটাই একটি ইংরেজি প্রবাদে এই বলে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ব্যতিক্রমি ব্যাপার এমন হয়ে থাকে যে, তাতে সংশিষ্ট মূলনীতির খণ্ডন তো হয়ই না, অধিকন্তু তা আরো সংহত অকাট্য হয়।
"There are some exceptions which prove the Rule."
যাহোক, প্রকৃত ব্যাপার হলো, কুরআন ছাড়াও রসূল সা.-এর উপর বহু ওহী অবতীর্ন হয়েছে। আর সেসব ক্ষেত্রে ওহী আসেনি, অথচ ব্যাপারটি রিসালাত বা নবুওয়াতের দায়িত্বের সাথে সংশিষ্ট, সে ক্ষেত্রে ওহী নাযিল না হওয়াটাই প্রমাণ করে যে, ঘটনা ও কার্যকলাপ যাই ঘটে থাকুক না কেন, হুবুহু আল্লাহর ইচ্ছে ও সম্মতি অনুযায়ীই সংঘটিত হয়েছে। অবশ্য পালনীয় ও অবশ্য কর্তব্য হবার ব্যাপারে ওহীভিত্তিক নির্দেশের সাথে তার কোনোই পার্থক্য নেই। সুতরাং সেইসব ক্ষেত্রে কোনো মুসলমানেরাই নবীর হুকুমের আনুগত্য পরিত্যাগ করার জন্য এই ওজুহাত দাঁড় করানো বৈধ নয় যে, নবীর কোনো বিশেষ নির্দেশ ওহীভিত্তিক নয় বা তা ওহীভিত্তিক হবার কোনো প্রমাণ সে পায়নি।
এবার 'এদারায়ে সাকাফাতে ইসলামিয়া' কর্তৃক প্রকাশিত 'মাকামে সুন্নাত' নামক গ্রন্থটির প্রসঙ্গে আসা যাক। এ বই আমিও পড়ে ফেলেছি। বইটা পড়লে মনে হয়, লেখক 'মানিও না অমান্যও করি না' ধরনের নীতির অনুসারী। প্রথমে তো তিনি স্বকল্পিতভাবে হাদিসপন্থী ও হাদিস বিরোধীদের শিবির থেকে সরে গিয়ে উভয় শিবির থেকে সম দূরত্বে অবস্থিত সত্যাশ্রয়ী তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নিজের একটি আলাদা শিবির স্থাপন করেছেন। কিন্তু পাঠক যখন বইটি অধ্যয়ন করতে করতে ক্রমশ সামনে অগ্রসর হয়, তখন দেখা যায়, তিনি হদিস বিরোধীদের শিবিরের দিকে ঘনিষ্ঠতর হতে যাচ্ছেন। এমনকি কোথাও কোথাও আমাদের মতো হাদিসপন্থীদের দৃষ্টিতে এমনও মনে হয় যে, লেখকের সাথে হাদিস বিরোধীদের অতি সামান্যই দূরত্ব বজায় রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও তাকে হাদিস বিরোধীদের অস্ত্র ধার করে হাদিসপন্থীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও দেখা যায়। তার যে উক্তিগুলোর আপনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাতেই দেখা যায়, তিনি সূচনা করেছেন এই বলে যে, রসূল সা.-এর সকল কার্যকলাপ ও কথাবার্তা ওহীর সাথে সামঞ্জস্যশীল, কিন্তু অবিকল ওহী নয়। তবে তার অল্প কিছু অংশ ইল্হাম। (অবচেতনভাবে অন্তরে আবির্ভূত ঐশী আভাস ইঙ্গিত, ধ্যান-ধারণা বা প্রজ্ঞা, যা নবীদের বেলায় ওহীর পর্যায়ভুক্ত-অনুবাদক) কিন্তু আলোচনার সমাপ্তি টানেন এই বলে যে, বড়জোর দু'তিনটি ক্ষেত্রে রসূলের হাদিসের ইল্হামভিত্তিক বলে মেনে নেয়া যেতে পারে। তবে যেহেতু প্রেক্ষাপটটি পরিবর্তনশীল, তাই নবীর আমলের অনেক ব্যাপার অন্য যুগে রদবদলের যোগ্যও হতে পারে।
বুখারি ও মুসলিম শরিফের তায়াম্মুম সংক্রান্ত হাদিস প্রসঙ্গে যে বক্তব্য বিশ্লেষণ বইটিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাও পড়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি নিদারুণভাবে বিস্মিত ও বেদনাহত হয়েছি এই ভেবে যে লেখক নিজে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন হোন, তা বলে অন্যকেও বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলেন কেন, আর কিছুমাত্র চিন্তাভাবনা ও বিচারবিবেচনা ছাড়াই সাহাবা ও হাদিসবেত্তাগণ সমেত সকল আধুনিক ও প্রাচীন মনীষীকে উপহাস ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করার ঔদ্ধত্য কিভাবে দেখালেন?
এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য হলো, গোসল ও তায়াম্মুম সংক্রান্ত আলোচনা কুরআনে দু'জায়গায় এসেছে। একটি সূরা আন নেসায়, অপরটি সূরা মায়েদায়। যথা :
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের ধারে কাছে যেয়ো না, যতোক্ষণ না মুখে কি বলছো টের পাও। প্রবাসে থাকা অবস্থায় ছাড়া বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা নিয়েও নামাযের কাছে যেয়ো না যতোক্ষণ না গোসল করে নাও। তবে আমরা রুগ্ন ও সফররত থাকলে কিংবা পেশাব পায়খানা ও স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করার পর পানি না পেলে তায়াম্মুম করে নিও।" [সূরা আন নিসা, আয়াত : ৪৩]
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"আর যদি তোমরা বীর্যপাতজনিত কারণে অপবিত্র হয়ে থাক তবে পবিত্র হয়ে নাও। যদি রুগ্ন কিংবা সফররত থাক, অথবা যদি তোমাদের কেউ পেশাব পায়খানা কিংবা স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করার পর পানি না পায়, তাহলে তায়াম্মুম করে নাও।" [সূরা আল মায়দা, আয়াত : ০৬]
উভয় স্থানে যেখানে, প্রথমে 'জুনুবান' (বীর্যপাতজনিত অপবিত্রাবস্থার) উল্লেখ রয়েছে সেখানে 'গোসল কর' বা 'পবিত্র হওয়া'র নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে যেখানে পানি না পাওয়া যায়, সেখানে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেখানে ---------- (স্ত্রীর সাথে মেলামেশার) শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। এ শব্দটি যদিও প্রতীকী অর্থে সঙ্গম বুঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে, তবে এর প্রত্যক্ষ অর্থ তা নয়। 'লাম্স' শব্দের আসল অর্থ যে 'স্পর্শ করা' তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই এ আয়াতের মর্ম ও তাৎপর্য নিরূপণে সাহাবা, তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে।------------- এর অর্থ কারো মতে স্ত্রীদেরকে নিছক স্পর্শ করা, কারো মতে কামভাব সহকারে স্পর্শ করা আবার কারো মতে সঙ্গম। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত ওমর, হযরত ইবনে ওমর, হযরত ইবনে আব্বাস এবং হযরত ইবনে মাসউদের মতে এ আয়াতে সঙ্গম নয় শুধু স্পর্শ করার কথা বলা হয়েছে। এই মত গ্রহণ করেছেন ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম জুহরী, ইমাম নাখয়ী এবং আরো কয়েকজন ইমাম। পক্ষান্তরে হযরত আলী এবং আরো কয়েকজন সাহাবির মতে এখানে স্পর্শ দ্বারা সঙ্গমই বুঝানো হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা ও অন্য কয়েকজন ফেকাহবিদ এই মতের অনুসারী। এখন আয়াতটিতে দু'রকম অর্থেরই অবকাশ যখন রয়েছে, তখন হযরত ওমর ও অন্য কতিপয় সাহাবি ---------- শব্দটিকে সঙ্গম অর্থে গ্রহণ না করলে তাদেরকে এ আয়াতের ভিত্তিতে দোষারোপ করা যায় কিভাবে? তারা যদি মনে করেন, এ আয়াত থেকে সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করার জন্য তায়াম্মুমের বৈধতা প্রমাণিত হয়না, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কুরআনের বিরুদ্ধাচরণ বা কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞতার মতো ভয়ংকর অভিযোগ আরোপ করা কিভাবে সমীচীন হয়? অনুরূপভাবে যে মনীষীগণ এই মতের অনুসারি, তাদের কাছে সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করতে তায়াম্মুম জায়েয- এই মর্মে কোনো হাদিস যদি না পৌঁছে থাকে কিংবা তারা তেমন কোনো হাদিসকে গ্রহণযোগ্য মনে না করে থাকেন, তাহলে সেজন্য তাদেরকে দোষারোপ করাই বা হবে কেন?
হযরত ওমরের উপর যেহেতু হযরত আম্মারের বর্ণিত হাদিস অগ্রাহ্য করার অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাই এ হাদিসটির বিশদ বিবরণ দিচ্ছি।
আসল ব্যাপার হলো, সফরে থাকা অবস্থায় হযরত আম্মারের যখন গোসলের প্রয়োজন দেখা দিলো এবং পানি না পাওয়ায় কি করা যায় তা জিজ্ঞেস করলে রসূল সা. তাঁকে বললেন যে, তায়াম্মুম করলেই চলবে, কিন্তু হযরত ওমর এই সমগ্র ঘটনা ভুলে যান। এমনকি পরে হযরত আম্মার তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে পড়েনি। এখন বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, হযরত আম্মার যখন হযরত ওমরকে বললেন যে, এ ঘটনা আপনার সামনেই ঘটেছিলো, তখন হযরত ওমর হয়তো আরো অবাক হয়েছেন এবং ভেবেছেন যে, যে ঘটনায় তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন, তা যদি হযরত আম্মারের মনে থেকে থাকে, তাহলে তিনি ভুলে যেতে পারলেন কিভাবে? সম্ভবত, এজন্যই তিনি হযরত আম্মারের কথা মেনে নিতে ইতস্তত করেছেন এবং নিজের এই মতে অটল থেকেছেন যে, তায়াম্মুম দ্বারা গোসলের কাজ হয়না এবং বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা থেকে গোসল ছাড়া পবিত্র হওয়া যায়না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, হযরত ওমর যে হাদিস গ্রহণ করেননি তা অন্যেরা কিভাবে গ্রহণ করলো! এর দুটো জবাব রয়েছে। প্রথমত: হযরত ওমর স্বভাবতই মনে করে থাকতে পারেন যে, একই ঘটনাকে তিনি নিজে ভুলে যাবেন অথচ আম্মার ভুলবেননা, তা হতে পারেনা। কিন্তু হযরত আম্মারের বর্ণনাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে হযরত ওমরের সামনে যেসব মনস্তাত্ত্বিক বাঁধা ছিলো, অন্যদের সামনে তা থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় জবাব এই যে, পানি না পাওয়া গেলে যে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করা চলে সে মর্মে রসূল সা.-এর অনুমতি অন্য কয়েকজন সাহাবি থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (উদাহরণস্বরূপ, বুখারি ও মুসলিম শরিফেই হযরত ইমরানের হাদিস দ্রষ্টব্য)। সুতরাং এটা অস্বাভাবিক নয় যে, হাদিসবেত্তাগণ যখন এ বিষয়ে বিভিন্ন সনদের হাদিস সংগ্রহ করেছেন, তখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, এ ব্যাপারে হযরত ওমর হয়তো মানসিক দুর্বলতাবশত বিস্মৃতির শিকার হয়েছেন। আসলে হযরত আম্মার ও অন্যান্য সাহাবির বর্ণনাই সঠিক।
পরিতাপের বিষয়, বুখারি ও মুসলিমের উল্লেখিত হাদিসের বিরুদ্ধে এতো সব আপত্তি উত্থাপন ও এমন আজগুবি ও উদ্ভট তত্ত্ব উদ্ভাবনের আগে কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতের শব্দগুলোর প্রতি যেমন খেয়াল করা হয়নি, তেমনি তাফসির, হাদিস ও ফেকাহর গ্রন্থাবলীতে এ বিষয়ের যে বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে, তা পড়ে দেখার কষ্টটুকুও স্বীকার করা হয়নি। কেবল 'হুজ্জাতুল্লাহ' গ্রন্থের একটি উক্তি দেখেই লেখক টিটকারি উপহাস ও ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের উদ্যম উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন এবং হযরত ওমর থেকে শুরু করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ পর্যন্ত সকলেরই সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু ভাব দেখে মনে হয় তিনি হুজ্জাতুল্লাহ গ্রন্থখানিও পুরোপুরি পড়ে দেখেননি। নচেত এই গ্রন্থেই বলা হয়েছে যে, --------- এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই গ্রন্থে একথাও বলা হয়েছে যে, এ আয়াত হযরত ওমরের অজানা ছিলো না। বরং তিনি এর শাব্দিক অর্থের উপরই নির্ভর করেছেন। হুজ্জাতুল্লাহ প্রথম খণ্ডের তায়াম্মুম সংক্রান্ত অধ্যায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হযরত ওমর ও হযরত ইবনে মাসউদ রা. বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হবার জন্য তায়াম্মুমকে যথেষ্ট মনে করতেন না। তারা এ সংক্রান্ত আয়াতের --------- শব্দটিকে নিছক স্পর্শ অর্থেই গ্রহণ করতেন। তবে এ দ্বারা তারা নারীকে স্পর্শ করতেই ওজু ভেঙ্গে যায় মনে করতেন।"
ভাবতে অবাক লাগে, ইসলামি বিধান সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন ও তত্ত্বানুসন্ধানের দায়িত্ব পালনে যারা এমন দু:খজনক শৈথিল্যে আক্রান্ত, তারা আবার 'সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা' নিরূপণের কাজেও আত্মনিয়োগ করে। [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারি ১৯৫৯]
প্রশ্ন : মুসলমানদের সর্বসম্মত বিশ্বাস হলো, রসূল সা.-এর উপর কুরআন ছাড়াও ওহী নাযিল হতো। সেই ওহীই আমাদের কাছে রসূলের সা. হুকুম ও বাণী হিসেবে বিদ্যমান। কিন্তু আজকাল কেউ কেউ বলছেন, কুরআন ছাড়া আর কোনো ওহী আসতোনা। তাদের সবচেয়ে বড় যুক্তি এই যে, রসূল সা.-এর প্রত্যেকটি কথাই যদি ওহীভিত্তিক হতো, তা হলে তাঁর কোনো কোনো কথায় কুরআনের সমালোচনা করা হয়েছে কেন এবং অন্যদের কথায় তিনি নিজের কোনো কোনো মত পরিবর্তন করেছেন কেন? কোনো কোনো হাদিসে তো এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। 'মাকামে সুন্নাত' (সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা নামক একখানা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। ঐ পুস্তকে কুরআন ছাড়া আর কোনো ওহী আসতো না- এই মতের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও তার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে উল্লেখিত যুক্তির পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। অধিকন্তু গ্রন্থকার এটিকে একটি অকাট্য যুক্তি হিসেবে পেশ করার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, হাদিসে কুদসী (যে হাদিসে স্বয়ং আল্লাহর উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে) এবং ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে রসূল সা.-এর কথা ও কাজ ওহী নয়। তাই ওগুলোতে রদবদল চলতে পারে। অনুগ্রহপূর্বক ব্যাখ্যা করুণ যে, ওহীকে কুরআনের মধ্যে এবং নবী জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশে সীমাবদ্ধ মনে করার এই মতবাদ কতখানি সঠিক?
'মাকামে সুন্নাত' নামক বইটির আরো কয়েকটি বিষয় গভীর বিচার বিবেচনার দাবি রাখে। জানিনা আপনি ওটা পড়ে দেখেছেন কিনা। এক জায়গায় তিনি 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা' গ্রন্থের বরাত দিয়ে লিখেছেন বুখারি ও মুসলিম শরিফে এই মর্মে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, পানির অভাব দেখা দিলে সহবাসজনিত অপবিত্রতা দুরিকরণে তায়াম্মুম গোসলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে কিনা সে ব্যাপারে হযরত ওমর রা. ও হযরত আম্মার রা.-এর মধ্যে আজীবন মতবিরোধ চলছিলো। অথচ কুরআনে দুই জায়গায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এরূপ ক্ষেত্রে তায়াম্মুম করে নাও। এ দ্বারা কি বুঝা যায় যে, উভয় সাহাবি কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন এবং তাঁদেরকে কুরআনের উক্ত বক্তব্য অবহিত করারও কেউ ছিলোনা? অথবা কুরআন সাহাবাদের নিকট চূড়ান্ত দলিল ছিলোনা? আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হযরত আম্মার তায়াম্মুমের পক্ষে এই বলে যুক্তি প্রদর্শন করতেন যে, রসূল সা.-এর অনুমতি দিয়েছেন। অথচ তাতেও হযরত ওমর রা. আশ্বস্ত হতে পারেননি। তবে পরবর্তী কালের লোকেরা আশ্বস্ত হয়ে গেছে এবং তাও হয়েছে কুরআন দ্বারা নয় বরং এই হাদিস দ্বারা। কারণ তাদের কাছেও কুরআনের চেয়ে হাদিস অগ্রগণ্য। মোটকথা, এই সর্বসম্মত হাদিসের উপর অনেক লম্বা চওড়া আপত্তি তোলা হয়েছে এবং ইচ্ছেমত উপহাস করা হয়েছে। এতে আমার মন নিদারুণভাবে ক্ষুব্ধ। প্রশ্ন হলো, এ হাদিসটি কি শুদ্ধ? এর তাৎপর্য কি?
জবাব : রিসালতের পদটির মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করা, রসূলের সুন্নাহর সাথে উম্মাতের সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সুন্নাহর আইনগত মর্যাদাকে জনসাধারণের চোখে সংশয়পূর্ণ ও গুরুত্বহীন করে তোলার দুরভিসন্ধি নিয়ে এ যাবত যে কয়টি মতবাদ রচিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি মতবাদ এই যে, রসূল সা.-এর নিকট মাত্র এক ধরনের ওহী নাযিল হয়েছে, যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরে আর কোনো ওহীর কথা স্বীকার করা ইহুদীদের কুসংস্কার, যার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। সুন্নাহর অতীব মহান ও পবিত্র ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা ছাড়াও এই মতবাদ দ্বারা আরো একটি যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সেটি হলো সুন্নাহ যেহেতু ওহীভিত্তিক নয়, তাই ওটা কেবল রসূল সা.-এর ব্যক্তিগত চিন্তা গবেষণা প্রসূত অভিমত মাত্র। এটি কোনো সর্বজন মান্য আইনের মর্যাদা রাখেনা। বরঞ্চ মুসলমানরা নিজস্ব চিন্তা গবেষণার ভিত্তিতে এর বিপরীত সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এটা যে কতদূর ভ্রান্ত মতবাদ, তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। কেননা খোদ কুরআন থেকেই প্রমাণিত যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত পঠিত ও লিখিত ওহী ছাড়াও এমন বহু ওহী শুধু মুহাম্মদ সা. নয় বরং আল্লাহর প্রত্যেক নবীর কাছেই নাযিল হতো, যার উপর নিজের আমল করা এবং গোটা উম্মতকে দিয়ে আমল করানো সকল নবীর নবুওয়াতের উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সব ওহীকে এরূপ মনে করারও অবকাশ ছিলোনা যে, তা হয়তো মৌমাছির নিকট অবচেতনভাবে বা প্রাকৃতিকভাবে প্রেরিত প্রত্যাদেশের মতো হবে। অথবা আকাশ ও পৃথিবীর নিষ্প্রাণ পদার্থের নিকট অবতীর্ণ প্রাকৃতিক ওহীর মতো হবে। তথাপি হাদিস বিরোধীদের কর্মপন্থা এই যে, যে জিনিস তাদের কাছে ভালে লাগে ও তাদের স্বার্থের অনুকূল হয়, সেটা উদ্ধারের পথে অন্তরায় হয়, তা কুরআনে যে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, এই গোষ্ঠি ভুলেও তার কথা মুখে আনেনা। কিন্তু কুরআন ছাড়া রসূল সা.-এর নিকট আর কোনো ওহী আসতোনা এই মর্মে কোনো যুক্তি প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় কিনা, তার অন্বেষণে তারা হাদিস কুরআন দুটোই চষে ফেলতে ভীষণ তৎপর। এ ধরণের কোনো প্রমাণ উদ্ধার করা তো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কুরআন ও হাদিসে এরূপ মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি ঘটনা তাদের হস্তগত হয়েছে।, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, রসূল সা.-এর কোনো কাজে ওহী দ্বারা সাবধান করা হয়েছে, অথবা রসূল সা. কারো পরামর্শে নিজের মত পরিবর্তন করেছেন। আর এইটুকু মাল-মশলা হাতে পেয়েই তা দিয়ে তারা নিজেদের মনগড়া মতবাদের সপক্ষে যুক্তিতর্কের এক বিরাট প্রাসাদ গড়ে তুলেছে।
এই যুক্তিতর্ক নিয়ে যদি সামান্যতম চিন্তাভাবনাও করা হয়, তা হলে পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, এতে যে ঘটনাগুলোকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে, তা দ্বারা কু্রআন বহির্ভুত ওহীর অস্তিত্ব অস্বীকারকারীদের বক্তব্য যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়না, তেমনি তা দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের দাবিও অসত্য প্রমাণিত হয়না। অস্বীকারকারীদের বক্তব্য হলে রসূল সা.-এর উপর কুরআন ব্যতীত আর কোনো ওহী কোনো ব্যাপারেই নাযিল হয়নি। উল্লেখিত ঘটনাবলী দ্বারা শুধু এতোটুকুই প্রমাণিত হয় যে, কিছু কিছু ব্যাপারে এমনও রয়েছে যাতে ওহী অবতীর্ণ হয়নি কিংবা যাতে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কিছুটা বিরতি ঘটেছিলো। অস্বীকারকারীদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। পক্ষান্তরে সাধারণ মুসলিম জনতার বক্তব্য ও বিশ্বাস হলো, রসূল সা.-এর কথা ও কাজ হয় অবিকল ওহীভিত্তিক, নতুবা ওহীর নির্দেশে সম্পাদিত হয়েছে। তাই তা আল্লাহর ইচ্ছে ও সন্তোষের সর্বোত্তম প্রতীক। আর যদি কোনো কাজ ওহীর নির্দেশিত পথ থেকে সামান্য পরিমাণেও সরে গিয়ে থাকে, তবে ওহীর মাধ্যমেই তৎক্ষনাৎ তা শুধরে দেয়া হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নবীদের নিষ্প্রাণ হওয়ার যে তত্ত্ব প্রমাণিত তা এটাই। কেবল গুটিকয়েক ঘটনা ও কার্যকলাপ ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ঘটনা ও কার্যকলাপ এমনি ধরনের যে, তাতে রসূল সা.-এর কর্মপদ্ধতি হয় হুবুহু ওহীভিত্তিক, নচেত তা ওহীর দাবি ও আল্লাহর ইচ্ছেকে এমন নিখুঁতভাবে ও ইপ্সিত মানে পূর্ণ করতো যে, তাতে আর ওহীর মাধ্যমে সংশোধনের প্রয়োজনই থাকতোনা। সে ক্ষেত্রে ওহীর নিরবতা বা নাযিল না হওয়াটাও মূলত সম্মতি ও অনুমোদনেরই পর্যায়ভুক্ত। অন্যথায় যে নবীর উপর ওহীর এমন কঠোর তদারকী বিরাজ করতো যে, তিনি শুধু ঠোঁট নাড়লেই ------------------ (তুমি জিভ নেড়ো না) বলে সতর্ক করে দেয়া হতো, এবং যিনি একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেই সূরা নাযিল হয়ে যেতো, সেই নবী নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে আল্লাহর সন্তুষ্টি চুল পরিমাণ লংঘন করবেন অথচ ওহী এসে তৎক্ষণাৎ তাঁকে শুধরে দেবেন না, এটা কিভাবে কল্পনা করা যেতে পারে? কাজেই গুটিকয়েক ঘটনাকে বেছে বেছে দেখালেই আমাদের এ বক্তব্য খণ্ডিত হয়না যে, মোটামুটিভাবে এবং সামগ্রিকভাবে গোটা নবী জীবন ওহীর পথনির্দেশনার উপর প্রতিষ্ঠিত। বরঞ্চ সতর্কীকরণ ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে ওহী নাযিল হওয়ার মাত্র গুটিকয় ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা আমাদের বক্তব্যকে আরো মজবুত করে।
বিরোধী পক্ষ এখানে এই বলে আপত্তি জানাতে পারে যে, রসূল সা.-এর নির্মল জীবন ও মহৎ চরিত্রের অধিকাংশ ওহীভিত্তিক বলে সাধারণ মুসলমানগণ বিশ্বাস পোষণ করে এ কথা ঠিক নয়। কেননা তাদের অনেকেই মনে করে রসূলের প্রতিটি তৎপরতাই ওহী। এ দাবির সপক্ষে তারা -------------------------------------------- (তিনি মনগড়াভাবে কোনো কথাই বলেন না। তিনি যাই বলেন তা ওহী ছাড়া আর কিছু নয়।) এই আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকে। আমি এর জবাবে বলতে চাই, আসলে এই দু'টো বক্তব্যের মধ্যে কোনো বৈপরিত্য নেই নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রসূল সা.-এর পক্ষ থেকে যে হাজারো কথা, কাজ, আদেশ ও নিষেধ জারি হয়েছে তার মধ্যে অতি নগণ্য ও বিরল সংখ্যকই এমন রয়েছে, যা ওহীভিত্তিক নয়। এগুলো সংখ্যায় এতো অল্প যে তা হিসেবে ধরার মতোই নয় এবং তাতে -------------------------------- "তিনি যাই বলেন তা ওহী ছাড়া কিছু নয়" উক্তিটি থেকে যে মূলনীতি উদ্ভাবন করা হয়েছে, (অর্থাৎ রসূলের জীবন ও কর্ম সামগ্রিকভাবে ওহীভিত্তিক) তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনা। যে বক্তব্য শতকরা ৯৯ বা তার চেয়েও বেশি অংশের ব্যাপারে সঠিক ও প্রযোজ্য, তাকে যদি মূলনীতির আকারে বর্ণনা করা হয়, তবে এই বচনভঙ্গিটি মোটেই অসত্য এ অশুদ্ধ নয়। সামগ্রিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার বেলায় অধিকাংশের বা সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থাটাই সব সময় প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। এ সত্যটাই একটি ইংরেজি প্রবাদে এই বলে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ব্যতিক্রমি ব্যাপার এমন হয়ে থাকে যে, তাতে সংশিষ্ট মূলনীতির খণ্ডন তো হয়ই না, অধিকন্তু তা আরো সংহত অকাট্য হয়।
"There are some exceptions which prove the Rule."
যাহোক, প্রকৃত ব্যাপার হলো, কুরআন ছাড়াও রসূল সা.-এর উপর বহু ওহী অবতীর্ন হয়েছে। আর সেসব ক্ষেত্রে ওহী আসেনি, অথচ ব্যাপারটি রিসালাত বা নবুওয়াতের দায়িত্বের সাথে সংশিষ্ট, সে ক্ষেত্রে ওহী নাযিল না হওয়াটাই প্রমাণ করে যে, ঘটনা ও কার্যকলাপ যাই ঘটে থাকুক না কেন, হুবুহু আল্লাহর ইচ্ছে ও সম্মতি অনুযায়ীই সংঘটিত হয়েছে। অবশ্য পালনীয় ও অবশ্য কর্তব্য হবার ব্যাপারে ওহীভিত্তিক নির্দেশের সাথে তার কোনোই পার্থক্য নেই। সুতরাং সেইসব ক্ষেত্রে কোনো মুসলমানেরাই নবীর হুকুমের আনুগত্য পরিত্যাগ করার জন্য এই ওজুহাত দাঁড় করানো বৈধ নয় যে, নবীর কোনো বিশেষ নির্দেশ ওহীভিত্তিক নয় বা তা ওহীভিত্তিক হবার কোনো প্রমাণ সে পায়নি।
এবার 'এদারায়ে সাকাফাতে ইসলামিয়া' কর্তৃক প্রকাশিত 'মাকামে সুন্নাত' নামক গ্রন্থটির প্রসঙ্গে আসা যাক। এ বই আমিও পড়ে ফেলেছি। বইটা পড়লে মনে হয়, লেখক 'মানিও না অমান্যও করি না' ধরনের নীতির অনুসারী। প্রথমে তো তিনি স্বকল্পিতভাবে হাদিসপন্থী ও হাদিস বিরোধীদের শিবির থেকে সরে গিয়ে উভয় শিবির থেকে সম দূরত্বে অবস্থিত সত্যাশ্রয়ী তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নিজের একটি আলাদা শিবির স্থাপন করেছেন। কিন্তু পাঠক যখন বইটি অধ্যয়ন করতে করতে ক্রমশ সামনে অগ্রসর হয়, তখন দেখা যায়, তিনি হদিস বিরোধীদের শিবিরের দিকে ঘনিষ্ঠতর হতে যাচ্ছেন। এমনকি কোথাও কোথাও আমাদের মতো হাদিসপন্থীদের দৃষ্টিতে এমনও মনে হয় যে, লেখকের সাথে হাদিস বিরোধীদের অতি সামান্যই দূরত্ব বজায় রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও তাকে হাদিস বিরোধীদের অস্ত্র ধার করে হাদিসপন্থীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও দেখা যায়। তার যে উক্তিগুলোর আপনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাতেই দেখা যায়, তিনি সূচনা করেছেন এই বলে যে, রসূল সা.-এর সকল কার্যকলাপ ও কথাবার্তা ওহীর সাথে সামঞ্জস্যশীল, কিন্তু অবিকল ওহী নয়। তবে তার অল্প কিছু অংশ ইল্হাম। (অবচেতনভাবে অন্তরে আবির্ভূত ঐশী আভাস ইঙ্গিত, ধ্যান-ধারণা বা প্রজ্ঞা, যা নবীদের বেলায় ওহীর পর্যায়ভুক্ত-অনুবাদক) কিন্তু আলোচনার সমাপ্তি টানেন এই বলে যে, বড়জোর দু'তিনটি ক্ষেত্রে রসূলের হাদিসের ইল্হামভিত্তিক বলে মেনে নেয়া যেতে পারে। তবে যেহেতু প্রেক্ষাপটটি পরিবর্তনশীল, তাই নবীর আমলের অনেক ব্যাপার অন্য যুগে রদবদলের যোগ্যও হতে পারে।
বুখারি ও মুসলিম শরিফের তায়াম্মুম সংক্রান্ত হাদিস প্রসঙ্গে যে বক্তব্য বিশ্লেষণ বইটিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাও পড়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি নিদারুণভাবে বিস্মিত ও বেদনাহত হয়েছি এই ভেবে যে লেখক নিজে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন হোন, তা বলে অন্যকেও বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলেন কেন, আর কিছুমাত্র চিন্তাভাবনা ও বিচারবিবেচনা ছাড়াই সাহাবা ও হাদিসবেত্তাগণ সমেত সকল আধুনিক ও প্রাচীন মনীষীকে উপহাস ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করার ঔদ্ধত্য কিভাবে দেখালেন?
এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য হলো, গোসল ও তায়াম্মুম সংক্রান্ত আলোচনা কুরআনে দু'জায়গায় এসেছে। একটি সূরা আন নেসায়, অপরটি সূরা মায়েদায়। যথা :
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের ধারে কাছে যেয়ো না, যতোক্ষণ না মুখে কি বলছো টের পাও। প্রবাসে থাকা অবস্থায় ছাড়া বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা নিয়েও নামাযের কাছে যেয়ো না যতোক্ষণ না গোসল করে নাও। তবে আমরা রুগ্ন ও সফররত থাকলে কিংবা পেশাব পায়খানা ও স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করার পর পানি না পেলে তায়াম্মুম করে নিও।" [সূরা আন নিসা, আয়াত : ৪৩]
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"আর যদি তোমরা বীর্যপাতজনিত কারণে অপবিত্র হয়ে থাক তবে পবিত্র হয়ে নাও। যদি রুগ্ন কিংবা সফররত থাক, অথবা যদি তোমাদের কেউ পেশাব পায়খানা কিংবা স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করার পর পানি না পায়, তাহলে তায়াম্মুম করে নাও।" [সূরা আল মায়দা, আয়াত : ০৬]
উভয় স্থানে যেখানে, প্রথমে 'জুনুবান' (বীর্যপাতজনিত অপবিত্রাবস্থার) উল্লেখ রয়েছে সেখানে 'গোসল কর' বা 'পবিত্র হওয়া'র নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে যেখানে পানি না পাওয়া যায়, সেখানে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেখানে ---------- (স্ত্রীর সাথে মেলামেশার) শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। এ শব্দটি যদিও প্রতীকী অর্থে সঙ্গম বুঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে, তবে এর প্রত্যক্ষ অর্থ তা নয়। 'লাম্স' শব্দের আসল অর্থ যে 'স্পর্শ করা' তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই এ আয়াতের মর্ম ও তাৎপর্য নিরূপণে সাহাবা, তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে।------------- এর অর্থ কারো মতে স্ত্রীদেরকে নিছক স্পর্শ করা, কারো মতে কামভাব সহকারে স্পর্শ করা আবার কারো মতে সঙ্গম। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত ওমর, হযরত ইবনে ওমর, হযরত ইবনে আব্বাস এবং হযরত ইবনে মাসউদের মতে এ আয়াতে সঙ্গম নয় শুধু স্পর্শ করার কথা বলা হয়েছে। এই মত গ্রহণ করেছেন ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম জুহরী, ইমাম নাখয়ী এবং আরো কয়েকজন ইমাম। পক্ষান্তরে হযরত আলী এবং আরো কয়েকজন সাহাবির মতে এখানে স্পর্শ দ্বারা সঙ্গমই বুঝানো হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা ও অন্য কয়েকজন ফেকাহবিদ এই মতের অনুসারী। এখন আয়াতটিতে দু'রকম অর্থেরই অবকাশ যখন রয়েছে, তখন হযরত ওমর ও অন্য কতিপয় সাহাবি ---------- শব্দটিকে সঙ্গম অর্থে গ্রহণ না করলে তাদেরকে এ আয়াতের ভিত্তিতে দোষারোপ করা যায় কিভাবে? তারা যদি মনে করেন, এ আয়াত থেকে সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করার জন্য তায়াম্মুমের বৈধতা প্রমাণিত হয়না, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কুরআনের বিরুদ্ধাচরণ বা কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞতার মতো ভয়ংকর অভিযোগ আরোপ করা কিভাবে সমীচীন হয়? অনুরূপভাবে যে মনীষীগণ এই মতের অনুসারি, তাদের কাছে সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করতে তায়াম্মুম জায়েয- এই মর্মে কোনো হাদিস যদি না পৌঁছে থাকে কিংবা তারা তেমন কোনো হাদিসকে গ্রহণযোগ্য মনে না করে থাকেন, তাহলে সেজন্য তাদেরকে দোষারোপ করাই বা হবে কেন?
হযরত ওমরের উপর যেহেতু হযরত আম্মারের বর্ণিত হাদিস অগ্রাহ্য করার অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাই এ হাদিসটির বিশদ বিবরণ দিচ্ছি।
আসল ব্যাপার হলো, সফরে থাকা অবস্থায় হযরত আম্মারের যখন গোসলের প্রয়োজন দেখা দিলো এবং পানি না পাওয়ায় কি করা যায় তা জিজ্ঞেস করলে রসূল সা. তাঁকে বললেন যে, তায়াম্মুম করলেই চলবে, কিন্তু হযরত ওমর এই সমগ্র ঘটনা ভুলে যান। এমনকি পরে হযরত আম্মার তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে পড়েনি। এখন বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, হযরত আম্মার যখন হযরত ওমরকে বললেন যে, এ ঘটনা আপনার সামনেই ঘটেছিলো, তখন হযরত ওমর হয়তো আরো অবাক হয়েছেন এবং ভেবেছেন যে, যে ঘটনায় তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন, তা যদি হযরত আম্মারের মনে থেকে থাকে, তাহলে তিনি ভুলে যেতে পারলেন কিভাবে? সম্ভবত, এজন্যই তিনি হযরত আম্মারের কথা মেনে নিতে ইতস্তত করেছেন এবং নিজের এই মতে অটল থেকেছেন যে, তায়াম্মুম দ্বারা গোসলের কাজ হয়না এবং বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা থেকে গোসল ছাড়া পবিত্র হওয়া যায়না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, হযরত ওমর যে হাদিস গ্রহণ করেননি তা অন্যেরা কিভাবে গ্রহণ করলো! এর দুটো জবাব রয়েছে। প্রথমত: হযরত ওমর স্বভাবতই মনে করে থাকতে পারেন যে, একই ঘটনাকে তিনি নিজে ভুলে যাবেন অথচ আম্মার ভুলবেননা, তা হতে পারেনা। কিন্তু হযরত আম্মারের বর্ণনাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে হযরত ওমরের সামনে যেসব মনস্তাত্ত্বিক বাঁধা ছিলো, অন্যদের সামনে তা থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় জবাব এই যে, পানি না পাওয়া গেলে যে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করা চলে সে মর্মে রসূল সা.-এর অনুমতি অন্য কয়েকজন সাহাবি থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (উদাহরণস্বরূপ, বুখারি ও মুসলিম শরিফেই হযরত ইমরানের হাদিস দ্রষ্টব্য)। সুতরাং এটা অস্বাভাবিক নয় যে, হাদিসবেত্তাগণ যখন এ বিষয়ে বিভিন্ন সনদের হাদিস সংগ্রহ করেছেন, তখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, এ ব্যাপারে হযরত ওমর হয়তো মানসিক দুর্বলতাবশত বিস্মৃতির শিকার হয়েছেন। আসলে হযরত আম্মার ও অন্যান্য সাহাবির বর্ণনাই সঠিক।
পরিতাপের বিষয়, বুখারি ও মুসলিমের উল্লেখিত হাদিসের বিরুদ্ধে এতো সব আপত্তি উত্থাপন ও এমন আজগুবি ও উদ্ভট তত্ত্ব উদ্ভাবনের আগে কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতের শব্দগুলোর প্রতি যেমন খেয়াল করা হয়নি, তেমনি তাফসির, হাদিস ও ফেকাহর গ্রন্থাবলীতে এ বিষয়ের যে বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে, তা পড়ে দেখার কষ্টটুকুও স্বীকার করা হয়নি। কেবল 'হুজ্জাতুল্লাহ' গ্রন্থের একটি উক্তি দেখেই লেখক টিটকারি উপহাস ও ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের উদ্যম উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন এবং হযরত ওমর থেকে শুরু করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ পর্যন্ত সকলেরই সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু ভাব দেখে মনে হয় তিনি হুজ্জাতুল্লাহ গ্রন্থখানিও পুরোপুরি পড়ে দেখেননি। নচেত এই গ্রন্থেই বলা হয়েছে যে, --------- এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই গ্রন্থে একথাও বলা হয়েছে যে, এ আয়াত হযরত ওমরের অজানা ছিলো না। বরং তিনি এর শাব্দিক অর্থের উপরই নির্ভর করেছেন। হুজ্জাতুল্লাহ প্রথম খণ্ডের তায়াম্মুম সংক্রান্ত অধ্যায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হযরত ওমর ও হযরত ইবনে মাসউদ রা. বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হবার জন্য তায়াম্মুমকে যথেষ্ট মনে করতেন না। তারা এ সংক্রান্ত আয়াতের --------- শব্দটিকে নিছক স্পর্শ অর্থেই গ্রহণ করতেন। তবে এ দ্বারা তারা নারীকে স্পর্শ করতেই ওজু ভেঙ্গে যায় মনে করতেন।"
ভাবতে অবাক লাগে, ইসলামি বিধান সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন ও তত্ত্বানুসন্ধানের দায়িত্ব পালনে যারা এমন দু:খজনক শৈথিল্যে আক্রান্ত, তারা আবার 'সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা' নিরূপণের কাজেও আত্মনিয়োগ করে। [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারি ১৯৫৯]